মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য এবং মুসলিম কবি ও শাসকদের অবদান

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য | ষোল ও সতেরো শতকের মুসলিম কবিদের কাব্যাদি আলোচনা করলে দেখা যায়, বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিদের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে রোমান্টিক ও অধ্যাত্ম প্রণয়কাহিনী। মুসলমান পূর্বযুগে বাংলা সাহিত্যের বিষয়বস্তু ছিল বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের শুদ্ধসাধন পদ্ধতির কথা ও লৌকিক দেব দেবীদের ক্রিয়া-কলাপ। কবিরা দেবদেবীর মাহাত্ম্য নিয়ে ব্যাপৃত থাকতেন, মানবীয় বিষয় নিয়ে সাহিত্য রচনার কথা তাদের চিন্তায়-ই আসে নি।

তাদের কাছে সাহিত্যচর্চা মানেই ছিল ধর্ম কেন্দ্রিক সাহিত্য রচনা। কিন্তু মুসলিম কবিরা সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে কেবল ধর্মকেই প্রাধান্য দিলেন না, তারা মানবীয় কাহিনী নিয়েও সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করলেন। সেই সাথে মুসলিম শাসকগণও উদার চিত্তে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করলেন। বাংলা সাহিত্যে মানবীয় রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান ধারার পথিকৃৎ হলেন শাহ মুহম্মদ সগীর।

এখনো amarStudy অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপটি ডাউনলোড না করে থাকলে গুগল প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপটি ইন্সটল করতে এখানে যানঃ Download Now. অ্যাপটি বিসিএস’সহ প্রায় সব রকমের চাকুরির প্রস্তুতির সহায়ক।

ড. এনামুল হকের মতে, শাহ মুহম্মদ সগীর সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের (১৩৮৯-১৪০৯ খ্রি.) পৃষ্ঠপোষকতায় ‘‘ইউসুফ জুলেখা’’ কাব্য রচনা করেন। কবি ‘‘ইউসুফ জুলেখা’’ -এর মূল কাহিনী সংগ্রহ করেন ‘‘কিতাবুল কোরান’’ থেকে। কিন্তু কাব্যখানি ধর্মীয় উপাখ্যান নয়, রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান যা মানবজীবন রসে সিক্ত।

শাহ মুহম্মদ সগীর মূলত কোরানে বর্ণিত ইউসুফ জুলেখাকে নতুন করে রক্ত-মাংস সংযোগ করে এক মোহনীয় মূর্তি সৃজন করেছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানদের দেশি ভাষার সাহায্যে মুসলিম ধর্মীয় প্রণয়োপখ্যানে সিক্ত করা এবং বাস্তবতা বর্জিত পুঁথিসাহিত্য থেকে পাঠককে প্রকৃত সাহিত্য রসে ফিরিয়ে আনা।

শাহ মুহম্মদ সগীর রস প্রধান সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা নিয়ে যে যুগের উম্মোচন করলেন পরবর্তীতে তাতে অনেকেই শরিক হন। এরমধ্যে কবি জৈনুদ্দিন অন্যতম। তিনি গৌড়ের সুলতান ইউসুফ শাহের (১৪৭৪-১৪৮১খ্রি.) সভাকবি ছিলেন। কবি ভণিতায় বার বার সুলতানের নাম উল্লেখ করেছেন। জৈনুদ্দিনের কাব্যের নাম ‘‘রসুল বিজয়’’। কাব্যটি হজরত মুহম্মদ (স.) কর্তৃক ইসলাম ধর্ম প্রচারের বিজয়াত্বক কাহিনী।

‘রসুল বিজয়’’ ঠিক মৌলিক কাহিনী নয়, কোনো ফারসি পুস্তক থেকে গৃহিত কাহিনীকে কবি নবরূপ দিয়েছেন। ১৬ শতকের রোমান্টিক প্রণয়োপখ্যান রচয়িতারেদর আরেক জন প্রভাবশালী কবির নাম পাওয়া যায় তিনি হলেন দৌলত উজির বাহরাম খান। তিনি পারস্যে লোককাহিনী ‘‘লাইলি মজনু’’ শীর্ষক বেদনা-বিধুর প্রেম-কাহিনীমূলক কাব্য রচনা করে মুসলিম সমাজে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।

কবি চট্টগ্রামের অধিপতি নেজাম শাহ শুরের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় কাব্যটি রচনা করেছিলেন। এ কাব্য শিল্প-মহিমা বা সাহিত্য-সম্পদে অতুলনীয় এবং কবিত্বে পরিপক্ক। সে যুগে রোমান্স সৃষ্টির প্রয়োজনে অলৌকিক ও অস্বাভাবিক ঘটনার সমাবেশ যেখানে অপরিহার্য ছিল, এ কাব্যের মধ্যে সে রকম অতিপ্রাকৃত ঘটনার চিহ্নমাত্র দেখা যায় না।

এ শতকেই কবি দোনাগাজি ‘‘ছয়ফুলমূলক বদিউজ্জামাল’’ কাব্য রচনা করেন। কাব্যটির বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘটনার সন্নিবেশে অপূর্ব এবং বর্ণনা কৌশলে অসাধারণ। যদিও অতিপ্রাকৃতের কুহেলিকার আবেষ্টনী থেকে ‘পরিকাহিনী’ নিজেকে আলাদা করতে পারে না তবুও যেন পৃথিবীর কথাই এ কাব্যের মধ্যে প্রতিভাত হয়।

১৭ শতকে কবি দৌলত কাজি আরকানের প্রধান সমর-সচিব আশরাফ খানের নিদের্শে ‘‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’’ কাব্য রচনা করেন। দৌলত কাজি মিয়াসাধনের ‘‘মৈনা কো সত’’ কাব্য থেকে তার ‘‘সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী’’-র উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন।

কাব্যটির দ্বিতীয় খণ্ডের ‘বারোমাস্যা’-এর একাদশ (আষাঢ়-বৈশাখ) মাস পর্যন্ত লিখে কবি মৃত্যুমুখে পতিত হন। পরে কবি আলাওল ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রধান অমাত্য সোলায়মানের অনুপ্রেরণায় কাব্যটির অবশিষ্ট অংশ সমাপ্ত করেন। পরবর্তী রোসাঙ্গরাজ সাদ উমাদার (থদো মন্তিার)-এর রাজত্বকালে তার মুখপাত্র বা প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুরের আশ্রয়ে থেকে মহাকবি আলাওল তার অমর কাব্য ‘‘পদ্মাবতী’’ রচনা করেছিলেন।

মাগন ঠাকুর ছিলেন কোরেশ বংশোদ্ভূত মুসলমান; আরকানরাজ প্রদত্ত তার উপাধি ছিল ‘ঠাকুর’। তিনি নিজেও কবি ছিলেন; তার কাব্যের নাম ‘‘চন্দ্রাবতী’’। সৈয়দ মুহম্মদ চন্দ্র সুধর্মার সমর-সচিব ছিলেন। মহাকবি আলাওল তার আদেশে ‘‘সপ্ত(হপ্ত) পয়কর’’ কাব্য রচনা করেন। ওই সময়ে মজলিস নামক এক ব্যক্তি সুধর্মার রাজসভার ‘নবরাজ’ ছিলেন। তার আদেশে আলাওল ‘‘সেকান্দার নামা’’-র পদ্যানুবাদ করেন।

একই রাজত্বকালে মন্ত্রী সৈয়দ মুসার আদেশে আলাওল ‘‘সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল’’ কাব্য রচনা করেন। মুসলমান কবিরা শুধু মুসলিম কাহিনী কাব্যই রচনা করেন নি, তারা ভারতীয় কাহিনী অবলম্বনেও কাব্য রচনা করেছেন। মুহম্মদ কবিরের ‘‘মধু মালতী’’ এবং শাহ বারিদ খানের ‘‘বিদ্যাসুন্দর’’-এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

‘‘মধু মালতী’’-র মূল উপখ্যান ভাগে গ্রিক কাহিনীর প্রভাব থাকলেও এটা একান্তই ভারতীয় কাহিনী তাতে সন্দেহ নেই। কবিরের পরে ‘‘মধু মালতী’’ নামে ফকির গরিবুল্লাহ ও সৈয়দ হামজাও কাব্য রচনা করেন। শাহ বারিদ খান ছাড়া ‘‘বিদ্যাসুন্দর’’ কাব্যের সব কবিই হিন্দু যাতে দেব দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে।

সুলতান ফিরোজ শাহ দু’জন কবিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন; তারা হলেন শ্রীধর ও আফজাল আলি। কবি শ্রীধর ‘‘বিদ্যাসুন্দর’’ কাব্য রচনা করেন। ‘‘বিদ্যাসুন্দর’’ হিন্দু লৌকিক ধর্মকাব্য। তার কাব্যে কালিকা দেবীর পূজা প্রচারিত হয়েছে। কবি আফজাল আলি ‘‘নসিহৎ নামা’’ নামে একটি পুস্তক এবং বৈষ্ণবীয় ঢঙে কয়েকটি পদ রচনা করেন।

‘‘নসিহৎ নামা’’ গ্রন্থের বিষয়বস্তু ধর্মোপদেশ। স্বপ্নাদেশচ্ছলে এতে ইসলাম ধর্মের নানা কথা আলোচিত হয়েছে।শুধু শ্রীধরই নয়, এ রকম অনেক হিন্দু কবিকে মুসলমান শাসকরা কাব্য রচনায় পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। কবি কৃত্তিবাস গৌড়েশ্বর জালাল উদ্দিন মুহম্মদ শাহ (১৪১৮-১৪৩১খ্রি.)-এর পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ‘‘রামায়ণ’’-রচনা করেন।

কাব্যখানি মহাকবি বাল্মিকীর সংস্কৃত ‘‘রামায়ণ’’-এর ভাবানুবাদ। বাঙালি কবির ভক্তিরসের প্রাধান্যে পৌরাণিক মহাকাব্য ধর্মীয় কাব্যে পরিণত হয়েছে। ‘‘ইউসুফ জুলেখা’’ ধর্মের বিষয় মানব প্রেমোপখ্যানে রূপ নিয়েছে আর কৃত্তিবাসের ‘‘রামায়ণ’’ মানবকাব্য অনুবাদের পর তা ধর্মকাব্যে রূপ নিয়েছে।

‘‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’’-এর রচয়িতা মালাধর বসুই একমাত্র কবি যিনি গৌড়েশ্বরের কাছে থেকে ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। গবেষকদের মতে, এই গৌড়েশ্বর হলেন সুলতান রুকন উদ্দিন বারবক শাহ(১৪৫৯-১৪৭৪খ্রি.)। তার পৃষ্ঠপোষকতায়ই ‘‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’’ রচিত হয়। এটি সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ ‘‘ভাবগত’’-এর অনুবাদ। এতে কৃষ্ণের ঐশ্বর্য ও মহিমা প্রচারিত হয়েছে।

‘‘মনসা মঙ্গল’’-এর রচয়িতা বিজয় গুপ্ত ও বিপ্রদাস সুলতান হুসেন শাহের প্রশস্তি রচনা করেছেন। ‘‘মহাভারত’’ অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বরও সুলতান হুসেন শাহের প্রশংসা করেছেন। কবীন্দ্র পরমেশ্বর চট্টগ্রামের প্রতিনিধি পরাগল খানের প্রত্যক্ষ নিদের্শে ‘‘মহাভারত’’-এর অনুবাদ করেন। গবেষকদের ধারণা, কবি বিজয় গুপ্ত ও বিপ্রদাস সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন।

হুসেন শাহের পুত্র সুলতান নসরত শাহের (১৫১৯-১৫৩১খ্রি.) আমলে কবি বিদ্যাপতি ও শেখ কবিরের নাম পাওয়া যায়, যারা বৈষ্ণব পদ রচনা করেছেন। বিদ্যাপতির ভণিতায় সুলতানের রসজ্ঞ মনের পরিচয় পাওয়া যায়। এদের দু’জনকেই সুলতান পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন।

পরিশেষে বলা যায়, মধ্যযুগে মুসলমান শাসক ও অমাত্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক নবজাগরণের সূচনা হয়। তাদের বদান্যতায় হিন্দু মুসলমান উভয় কবিগণই সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। তবে একমাত্র মুসলমান কবিরাই অতিপ্রাকৃতের বেড়াজাল চিন্ন করে মধ্যযুগের সাহিত্যে মানবীয় কাহিনী সন্নিবেশ করেন। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এক স্বকীয় বেশিষ্ট্যের মর্যাদা লাভ করে।

তথ্যসূত্রঃ দৈনিক ইনকিলাব

আরো পড়ুুন:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You're currently offline !!

error: Content is protected !!