বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবারের ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকটা বেশি। করোনা অতিমারির মতো এখন প্রতিদিন ডেঙ্গুতে মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। সময়মতো সঠিক চিকিৎসার অভাবে অকালে ঝড়ে যাচ্ছে অনেক প্রাণ। এর জন্য যেমন আমাদের অসচেতনতা দায়ি, ঠিক তেমনি অব্যবস্থাপনাও দায়ি।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগিদের ডাব খেতে হয়, তাই হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে ডাবের দাম। মাঝারি মানের একটি ডাবের দাম ২০০ পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। বিষয়টা কি এমন যে, ডাবের চাহিদা বেড়ে গেছে তাই হঠাৎ করে ডাবের সংকট দেখা দেওয়ায় দাম কয়েক গুণ ছাড়িয়ে গেছে?? নাকি ডাব আমরা বাইরে থেকে আমদানি করি??? এর কোনোটিই নয়।
ডাবের দাম হঠাৎ করে আকাশচুম্বী হওয়ার পেছনের কারণ হলো আমাদের ব্যবসায়ীরা। তারা সুযোগ পেলেই সিন্ডিকেট করে যেকোনো পণ্যের দাম রাতারাতি কয়েকগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়া অতিরিক্ত পরিমাণে মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে যেকোনো পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে আমাদের ব্যবসায়িরা খুব দক্ষ। যদি বিশ্বব্যাপী এরকম কোনো সূচক প্রকাশ করা হতো যে, কোন দেশের ব্যবসায়িরা সিন্ডিকেট করে রাতারাতি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে সেরা? আমি নিশ্চিত মানবাধিকার বা অন্যকোনো সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান যাই হোকনা কেনো, সিন্ডিকেটের সূচকে বাংলাদেশ ১ নম্বরে থাকবে।
হঠাৎ করে ডাবের দাম কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এটা অনেকের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে নিম্নবিত্ত/মধ্যবিত্ত পরিবারের ডেঙ্গু রোগিরা প্রয়োজন অনুযায়ী ডাব বা অন্যান্য পথ্য সঠিকভাবে মিলাতে পারছে না। অকালে ঝাড়ে যাচ্ছে অনেক প্রাণ, এটার দায়ভার কি তাদের উপর বর্তায় নাহ??
এই দায় কি শুধু ব্যবসায়িদের ?? অবশ্যই নাাা। একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা আছে, আছে তথাকথিত ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। কিন্তু তারপরেও এতো অনিয়ম কেন?? নিশ্চই সঠিকভাবে বাজার মনিটরিং হচ্ছেনা অথবা যারা বাজার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন এখানে তাদেরও স্বার্থ জড়িত আছে!! নতুবা তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেনা না!!!!
তবে একথা না বললেই নয়, গণমাধ্যমে বিগত কয়েকদিনের প্রচারণার জন্য আমাদের আমলারা এখন বাজার ব্যবস্থাপনায় উঠেপড়ে লেগেছেন। যা অবশ্যই প্রসংশনীয়। কিন্তু কতৃপক্ষ এটা কতদিন ধরে রাখতে পারবে, সেটাই এখন ভাবার বিষয়। আমাদের আরেকটা ট্রেন্ড হচ্ছে যখন কোনো একটা বিষয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে যায়, তখন সরকার সেটা সমাধানের জন্য উঠে পড়ে লাগে। এর অর্থ কি এরকম নয় যে, সমস্যা চরম পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত দায়িত্বরত কর্মকর্তা/কর্মচারীরা অপেক্ষায় থাকেন??? কোনো একটা সমস্যা চরম পর্যায়ে পৌছানোর আগে কি তাঁদের কিছুই করার নেই???
একজন ক্ষুদ্র প্রযুক্তি উদ্যোক্তা হিসেবে আমি বিশ্বাস করি তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে জনগণের ভোগান্তি অনেককাংশেই হ্রাস পাবে। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগগুলো অ্যাপ/ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দ্রব্যমূ্ল্য নির্ধারণ করে দিতে পারে এবং চাইলে উন্নত বিশ্বের মতো প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় পণ্যের মূল্য আপডেট করতে পারে। ভোক্তা কোনো পণ্য ক্রয় করার আগে অ্যাপের মধ্যে বর্তমান মূল্য দেখে নিশ্চিত হয়ে ন্যায্য মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে পারবে। তবে এজন্য প্রয়োজন যথেষ্ট সদিচ্ছা এবং সঠিক পরিকল্পনা!!!
এটা সত্য যে, জনবল সংকটের মতো অন্যকোনো সংকটের জন্য অনেক সময় সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দায়িত্বরত কর্মকতা সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারেন না, এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি তাদের অবহেলার কথা প্রায়শই গণমাধ্যমে উঠে আসে। কারণ- অনেক কর্মকর্তা নিজেদেরকে জনগণের সেবকের পরিবর্তে প্রভু মনে করেন। কাজেই জনগণের কি হলো, কি না হলো ওটা উনাদের দেখার বিষয় না।
এখন আসি ব্যবসায়ীদের বিষয়ে দু’চারটি কথা না বললেই নয়। অন্যান্য মুসলীম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে রমজান মাসে যেখানে দ্রব্যমূল্যের দাম কমতে দেখা যায়, ঠিক তার উল্টোটা হয় আমাদের ক্ষেত্রে। আমাদের সাধু-সন্ন্যাসী ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ীক মৌসুম হলো রমজান মাস। কিন্তু এখন সেই ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। তারা এখন বারোমাসেই রমজান মাস মনে করে। যখন যা ইচ্ছা তাই করে। যেমনঃ ৭০ টাকার ডাবের দাম রাতারাতি ২০০ টাকা ছাড়িয়ে দেওয়াটা তাদের কাছে কোনো ব্যপারই না। এর আগে আমরা ডিমকাণ্ড দেখেছি, যেখানে সাভারের দুইজন ডিমব্যবসায়ী মিলে সিন্ডিকেট করে রাতারাতি ডিমের দাম প্রায় দ্বিগুণ করেছিল। ডিম কিংবা ডাব অথবা অন্যকোনো ব্যবসায়ী হোক, তাদের কাছে রাতারাতি পণ্যের দাম বাড়ানোটা অনেকটা হাসিখেলার মতো মজার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
ইদানিং আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়। বাজারে কোনো কিছু কিনতে গেলে দাম বলা যায়না। বলে ভাই একদাম, নিলে নেন, না নিলে নাই!!! মানুষ জিম্মি হয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কম করে হলেও কিনছে, কারণ না কিনে তো আর উপায় নাই।
অনেকেই বলতে পারেন, কোভিতের জন্য বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। তা অবশ্যই ঠিক। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাংলাদেশে কি পরিমাণে বেড়েছে আর অন্যান্য দেশগুলোতে কতটুকু বেড়েছে এটা একটা সাদাপাগল মানুষও বুঝে। আমার স্পষ্টভাবে মনে আছে ২০১৬ সালে যখন ম্যাচে ছিলাম, তখন ৩০ জনের বাজার করতে হতো। ৩০ জনের বাজার করতে গিয়ে আমরা দোকানিকে বলতাম মামা ২ টাকার ডাল দেন। আজকে ৭ বছর পরে যদি কোনো একটা মুদির দোকানে গিয়ে বলি মামা ২ টাকার ডাল দেন তো!!! দোকানি ডাল না দিয়ে গাল (গালি) দিবে, এটা আমি নিশ্চিত।
বিগত কয়েক বছরে দ্রব্যমুল্যের এতো পরিমাণে উধ্বগতির জন্য শুধু মহামারিকে এককভাবে দায়ি করা কাম্য নয়। এর জন্য আমরা সকলেই দায়ি, তবে সবচেয়ে বেশি দায়ি হচ্ছে ব্যবসায়ীরা এবং তাদেরকে যারা মনিটর করতে ব্যর্থ তারা!!!! নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এতো বেশি পরিমাণে বেড়েছে যা নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের হাতের নাগালের বাইরে। প্রতিনিয়ত এসব নিয়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট হচ্ছে, তবুও মনেহয় দেখার কেউ নেই। যেন আমাদের রক্তের সাথে মিশে গেছে অনিয়ম, সিন্ডিকেট আর দুর্নীতি।
তবে চলতি মাসে ভোক্তা অধিকারসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটু বেশি সক্রিয় হতে দেখা যাচ্ছে, যার প্রভাবে বাজারে ২০০ টাকার ডাব এখন ৭০ টাকায় মিলছে। আশারাখি এর ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে______
এটার ধারাবাহিকতা বোজায় রাখতে আপনার-আমার, সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকে যথাযথ স্থান থেকে সঠিকভাবে কাজ করতে হবে। তবেই আমাদের মাঝে পরিবর্তন সূচিত হবে। আসুন আমরা রক্ত থেকে অনিয়মগুলো ঝেড়ে ফেলি, সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নিয়ে আসি। তবেই ভোক্তা তার অধিকার ফিরে পাবে, শ্রমিক/মজুর দিনশেষে ন্যায্য মূল্যে পণ্য কিনে বাড়ি ফিরবে, তবেই সুদিন ফিরবে।
আসুন পরিবর্তন শুরু হোক, আপনার-আমার থেকেই________
Tuesday, August 29, 2023 | Alamin Islam