১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | ১৭৫৭ তে পলাশীর যুদ্ধ খেলা’র মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার অবসান ঘটলো। শুরু হলো ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন ও শোষণ। কিন্তু ইংরেজরা উপমহাদেশের জনগণের ভাষা এবং রাজভাষা (ফার্সী) কোনোটির উপরই আঘাত হানেনি। ইংরেজরা ইংরেজিকে রাজভাষা করেছিল ১৮৩৭ সালে। আর যে কারণে উপমহাদেশে প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশরা শাসন ও শোষণ করতে পেরেছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালির ভাষার উপর প্রথম আঘাত হানে।

ফলশ্রুতিতে তেইশ বছরের পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙ্গে যায়। যে কারণে বাঙালির জাতীয় জীবনের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই পূর্ব বাংলার জনগণের পৃথক অস্তিত্বের চেতনা তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটে। এটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম। ভাষার দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাঙালি জাতির রক্তদান বিশ্ব ইতিহাসের একটি বিরল ঘটনা।

এখনো amarStudy অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপটি ডাউনলোড না করে থাকলে গুগল প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপটি ইন্সটল করতে এখানে যানঃ Download Now. অ্যাপটি বিসিএস’সহ প্রায় সব রকমের চাকুরির প্রস্তুতির সহায়ক।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | মূলত মাতৃভাষা মানুষের অতিপ্রিয়, মাতৃভাষার সাথে মানুষের আবেগ জড়িত। যে ভাষায় মানুষ কথা বলে সে ভাষার ওপর আঘাত আসলে তা কেউ মেনে নিতে চায় না। পূর্ব বাংলার লোকেরাও পারেনি যার স্বাক্ষী ভাষা আন্দোলনের রণক্ষেত্র রাজপথ। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ঘোষণাপত্রে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব ছিল।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন :

এরপর ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। শুরু হয় তীব্র বিতর্ক ও আন্দোলন সংগ্রাম। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু পূর্ব থেকেই বাংলা ভাষাকে উপমহাদেশে একটি মর্যাদাপূর্ণ ভাষায় পরিণয় করার জন্য এদেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিগণ চেষ্টা করে আসছিলেন। ১৯১১ সালে রংপুরে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ নওয়াব আলী সর্বপ্রথম বাংলাকে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব করেন। ১৯১৮ সালে শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত বিশ্বভারতীয় সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ভারতের সাধারণের ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভায় মওলানা আকরাম খাঁ বাংলাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে এ সময় পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের ধারণার ভিত্তিতে ১৯৪২ সালে একটি রেনেসাঁ সমাজ গঠিত হয়। ১৯৪৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস. এম হলে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে এতদঞ্চলের প্রচলিত ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম প্রাদেশিক কাউন্সিলের সামনে পেশ করার জন্য যে খসড়া ম্যানিফেস্টো প্রণয়ন করেছিলেন তাতে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক ভারত বিভাগ সম্পর্কিত রোয়েদাদ ঘোষণার পর মুসলিম লীগের অল্পসংখ্যক বামপন্থী কর্মীর উদ্যোগে জুলাই মাসে ঢাকায় ‘গণআজাদী লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক গ্রুপ গঠিত হয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | এ গ্রুপ “আশু দাবি কর্মসূচি আদর্শ” নামে যে ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করে তাতে বলা হয়: ‘মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষাকে দেশে যথোপযোগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বাংলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। বাংলা পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে এ কথার একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এ হতে পারে যে, তখন পর্যন্ত মুসলিম লীগ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। কাজেই গণআজাদী লীগের সদস্যদের হয়তো ধারণা ছিল যে, পাকিস্তানের দু অংশে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কায়েম হবে এবং তার ফলে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি রাষ্ট্রীয় একক হিসেবে গণ্য করা যাবে।

১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জোরালো প্রতিবাদ করেন এবং পরিবর্তে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার পক্ষে যুক্তি উত্থাপন করেন।

ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্ব :

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। জন্মলগ্নে পাকিস্তান পাঁচটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল পূর্ব বাংলা, পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। পূর্ববাংলা ভারতের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এবং বাকী চারটি প্রদেশ ভারতের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। ১৯৪৭ এর স্বাধীনতা লাভের পর পূর্ব বাংলার নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান আর অন্য চারটি প্রদেশকে একত্রে নামকরণ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তান।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দূরত্ব প্রায় ১২০০ মাইল, মাঝখানে ভারত। এ দু’ অংশের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, জীবন-যাপন পদ্ধতিসহ প্রায় সব বিষয়েই বিস্তর পার্থক্য ছিল। তবে একটি জায়গায় শুধু দু’অংশের মধ্যে মিল ছিল তা হচ্ছে। ধর্মের বন্ধন। এ ধর্মকে কেন্দ্র করেই দু’অংশের মধ্যে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে (হিন্দু-মুসলমান) পাকিস্তানের জন্ম হয় একটি মুসলিম অধ্যুষিত ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে।

রাষ্ট্রের নামকরণ করা হয় ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান। এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকালে (১৯৪৭ সালে) পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মোট জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৫৮ লক্ষ ৪২ হাজার। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ২০ লক্ষ ৬৩ হাজার অর্থাৎ মোট সংখ্যার ৫৫.৪৬%। পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের ভাষা ছিল বাংলা। পক্ষান্তরে সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানের লোকদের (৪৪.৬৪%) ভাষা ছিল উর্দু, সিন্ধী, পশতু ও বালুচ। বাংলা ভাষীরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছিল।

১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু (?) এ প্রশ্নে বাংলা ভাষীদের দাবী আরো তীব্র হতে শুরু করলো। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র এবং অধ্যাপকের উদ্যোগে তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে এ প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম ও আইন আদালতের ভাষা করার পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালায়। ঐ বছরই ১৫ সেপ্টেম্বর “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?” নামে তাঁরা একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | সে পুস্তিকায় তাঁরা বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, আদালতের ভাষা, অফিসের ভাষা ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা করার কথা বলেন। পুস্তিকাটিতে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বলা হয়, “লাহোর প্রস্তাবেও পাকিস্তানের প্রত্যেক ইউনিটকে সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার অধিকার দেয়া হয়েছে। কাজেই প্রত্যেক ইউনিটকে তাদের স্ব-স্ব প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব দিতে হবে।” এছাড়া পুস্তিকাটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন এবং তৎকালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদের ভাষা সম্পর্কিত প্রবন্ধও ছাপা হয়।

এদিকে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহার আরম্ভ করে দিয়েছিল। এ সময় পোস্টকার্ড মানিঅর্ডার ফরম, রেলওয়ে টিকেট প্রভৃতি ইংরেজি ও উর্দুতে লেখা হতো। শুধু তাই নয়, একই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার এক সার্কুলার জারি করলো যে, বাংলাকে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সিলেবাসভুক্ত করা যাবে না। এর প্রতিবাদে ঢাকা ভিত্তিক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিতে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবি জানাতে অনুরোধ করেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | ১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর ঢাকাতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির অর্থাৎ বিভাগপূর্ব আমলের অখণ্ড বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সর্বশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে বৈঠকে ওয়ার্কিং কমিটি এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, উর্দুকে পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা করা হবে না। এ বিচারে কমিটির সভাপতি মওলানা আকরাম খাঁকে সংবাদপত্রে একটি ঘোষণা প্রকাশ করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। মুসলিম লীগের এ বৈঠক প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের সরকারি বাসভবন “বর্ধমান হাউজে” (বর্তমান বাংলা একাডেমি ভবন) অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় বহু ছাত্র-শিক্ষক সেখানে উপস্থিত হয়ে বাংলাকে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। মওলানা আকরাম খাঁ তাঁদেরকে আশ্বাস দেন যে, তাঁদের দাবি সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করা হবে।

১৯৪৭ এর ডিসেম্বর থেকেই ভাষার দাবিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল ইত্যাদির প্রাধান্য বিস্তৃত হতে থাকে। আন্দোলনের পুরোধাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কামরুদ্দীন আহমদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপ্যাল আবুল কাসেম, মুনীর চৌধুরী, আবদুর রহমান চৌধুরী, কল্যাণ দাসগুপ্ত, এ কে এম আহসান, এস আহমেদ এবং আরো অনেকে। ১৯৪৭ সালেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যশ্রেণির মধ্যে সরকারবিরোধী মনোভাব গড়ে উঠতে থাকে এবং বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধ আন্দোলনের মধ্যে তার প্রতিফলন ঘটে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন :

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে উর্দু ও ইংরেজি ব্যবহার করার ফলে পূর্ব বাংলার জনসাধারণ ও শিক্ষিত মহলে যথেষ্ট উদ্বেগ ও বিরুদ্ধ মনোভাবের সৃষ্টি হয়। এ বিরুদ্ধ মনোভাবকে সাংগঠনিক রূপ দেয়ার প্রয়োজনেই ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তমদ্দুন মজলিস এবং মুসলিম ছাত্র লীগের অল্প কয়েকজন কর্মীর উপস্থিতিতে এ সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং তমদ্দুন মজলিসের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল হক এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | এ সংগ্রাম পরিষদ প্রথম দিকে পত্র পত্রিকায় বিবৃতি প্রদান, লেখালেখি আলোচনাসভা অনুষ্ঠান, সরকারি ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার এবং কিছু কিছু সভা-সমিতির মাধ্যমে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। পরবর্তী পর্যায়ে ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে গঠিত এ প্রথম সংগ্রাম পরিষদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায় :

ড. রঙ্গলাল সেনের মতে, প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলনের সফল সূচনা হয় ১৯৪৮ সালে, যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানের গণপরিষদে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর সপক্ষে জোর দাবি তোলেন। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এ অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি উত্থাপন করেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটির ওপর গণপরিষদে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | প্রস্তাবটির বিরোধিতা করতে গিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেন, “পাকিস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।” পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ও প্রতিনিধি তমিজউদ্দিন খান ও প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে বক্তৃতা দেন। তাঁরা যেসব বক্তব্য প্রদান করেন সেগুলোর বিরুদ্ধে পত্র-পত্রিকায় অনেক বিবৃতি ও সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হয়। কিন্তু শুধু পত্র-পত্রিকার বিরোধিতাই নয়, ছাত্র ধর্মঘট, মিটিং-মিছিল ইত্যাদির মাধ্যমেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়।

গণপরিষদের সিদ্ধান্ত এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগের বাংলা ভাষাবিরোধী নীতি ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও তমদ্দুন মজলিসের যৌথ উদ্যোগে ফজলুল হক হলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের একটি সভা আহ্বান করা হয়। ভাষা আন্দোলনকে প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক রূপ দেয়া এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে একটি ব্যাপকভিত্তিক সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত এ সভায় গৃহীত হয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” নামে এ সর্বদলীয় পরিষদে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে দুজন করে প্রতিনিধি মনোনীত হয় এবং আহ্বায়ক করা হয় শামসুল আলমকে। এ সভা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং সে সঙ্গে পাকিস্তান গণপরিষদে সরকারি ভাষার তালিকা থেকে বাংলা ভাষাকে বাদ দেয়ার প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়ে অপর একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন :

১১ মার্চ শুধু ঢাকাতেই নয়, ঢাকার বাইরেও অনেক জায়গায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। পূর্ব বাংলার প্রায় সর্বত্র ঐ দিন ছাত্র-ছাত্রীরা পূর্ণ ধর্মঘট পালন করে। এর পর সভা-সমাবেশ ও ধর্মঘটের মাধ্যমে আন্দোলন অব্যাহত থাকে। ১৪ মার্চ ১৯৪৮ সংগ্রাম পরিষদের সাথে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের একটি ৭ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দীনের চুক্তি সম্পাদন এবং শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম পরিষদের সবগুলি দাবি মেনে নেয়ার আসল কারণ ছিল পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফর।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | এ সফরের সময় জনগণ কর্তৃক, বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীগণ কর্তৃক সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের মতো কোনো পরিস্থিতির যাতে উদ্ভব না ঘটে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্যই নাজিমউদ্দীন ও তাঁর সরকার যথেষ্ট নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া তাঁরা আশা করেছিলেন যে, জিন্নাহ উর্দুর সপক্ষে প্রকাশ্যে মতামত প্রদান করলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে এবং পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন হবে। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ৮ মাসের মধ্যেই বাংলা ভাষার ওপর আঘাত হানার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেল পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর কণ্ঠে।

১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দানকালে এক পর্যায়ে তিনি উচ্চারণ করলেন- There can be only one lingua franca. That is the language for inter communication between the various provinces of the state, and that language should be urdu and cannot be any other; the state language, therefore, must obviously be urdu, a language that has been nurtured by a hundred million Muslims of this Sub-continent.”
জিন্নাহ সাহেবের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার সাথে সাথে ঐ সভার মধ্য থেকেই প্রতিবাদে ধ্বনি উচ্চারিত হয়ে ছিল “No… No… No…” এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন :

দীর্ঘকাল সংগ্রাম ও অনেক ত্যাগের বিনিময়ে এজন্য পাকিস্তান সৃষ্টি করা হয়নি। তাছাড়া জনসংখ্যার বিবেচনায়ও পূর্ব পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল ৫৫.৪৬%। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল ৪৪.৬৪%, তাও আবার চার প্রদেশ মিলে। সুতরাং সংখ্যাধিক্যের দিক দিয়েও বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবার দাবি রাখে। তাই নতুন রাষ্ট্রের শুরুতেই জিন্নাহ সাহেবের এ ধরনের একটি ঘোষণা পাকিস্তানের সংহতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। দুই অংশের ঐক্যে ফাটল দেখা দেয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | এরপর ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর একটি প্রতিনিধি দল জিন্নাহর সাথে সাক্ষাৎ করেন। জিন্নাহর একনায়ক সুলভ মনোভাবের কারণে ভাষা প্রশ্নে প্রতিনিধি দলের সাথে তীব্র বাক-বিতন্ডা হয়, কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। সাক্ষাৎকারের সময় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এর পক্ষ থেকে জিন্নাহর কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে একটি স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। জিন্নাহর পূর্ব বাংলা সফরের পর ১৯৪৮ সালের ৬ এপ্রিল পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক সভার যে অধিবেশন বসে তাতে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তাঁর চুক্তি লঙ্ঘন করে নিম্নলিখিত ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব পেশ করেন :

১. পূর্ব বাংলা প্রদেশে ইংরেজির স্থলে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করিতে হইবে; এবং

২. পূর্ব বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হইবে যথাসম্ভব বাংলা অথবা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ স্কলারদের মাতৃভাষা।
নাজিমউদ্দিন এ প্রস্তাব পেশ করার পর পরিষদে তুমুল বিরোধিতা ও হট্টগোল শুরু হলে জিন্নাহর মতামতের কথা উল্লেখ করে নাজিমউদ্দীন তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করেন। আন্দোলনের মুখে চুক্তি সম্পাদন এবং আন্দোলনের পর পরিস্থিতি পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে সে চুক্তিভঙ্গের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন বিশ্বাসঘাতকতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তা পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে একটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয়। এ ঘটনার পর ভাষা আন্দোলন কিছুদিনের জন্য স্তিমিত হয়ে পড়ে।

ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় :

আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ের পরিসমাপ্তির পর সরকারের আমলাতন্ত্র তাদের স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের প্রকাশ ঘটাতে থাকে। শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র, বাংলা হরফ পরিবর্তন করে আরবি হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা চালানো হয়। এ চেষ্টা ১৯৪৭ সালেই শুরু হয়েছিল এর প্রধান প্রবক্তা ছিলেন পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুল রহমান।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | নানা বক্তৃতা, বিবৃতি, সভা-সমিতির মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে ক্রমাগত একথা প্রচার করতে থাকেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি এবং দু অংশের জনগণের মধ্যে অর্থপূর্ণ ঐক্য গড়ে তোলা ও সুদৃঢ় করার জন্য পাকিস্তানের সকল ভাষার অক্ষর এক রকম হওয়া উচিত। হরফ পরিবর্তনের এ চক্রান্ত ভালোভাবে দানা বাঁধে ১৯৪৯ সালে। এরপর ১৯৫০ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা দপ্তরের উদ্যোগে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় ২০টি কেন্দ্রে আরবি হরফে বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রাপ্ত বয়স্কদেরকে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কাজ শুরু হয়। একটি সরকারি সূত্র থেকে বলা হয় যে, প্রত্যেক শিক্ষাকেন্দ্রে ২৫-৩৫ জন ছাত্র ঐভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছে এবং ছয় মাস কাল তারা ঐ কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষা লাভে নিযুক্ত থাকবে।

১৯৪৯ সালে প্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষার্থীদের জন্য অস্থায়ীভাবে গৃহীত পাঠ্যতালিকা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় খরচে আরবি হরফে বাংলা বই ছাপানো হয় এবং সেসব বই বিনামূল্যে ছাত্রদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া আরবি হরফে বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনাকারীদেরকে পুরস্কার প্রদান করা হবে এ মর্মে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তিও প্রচার করা হয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | আরবি হরফে বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের এ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলা ভাষা সংস্কার কমিটির সদস্য ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৫০ সালের ৪ অক্টোবর একটি বিবৃতি প্রদান করেন। এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে মওলানা আকরাম খাঁর সভাপতিত্বে গঠিত পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি তার এক রিপোর্টে বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রচলন অন্তত বিশ বছর স্থগিত রাখার জন্য সুপারিশ করেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর বিবৃতিতে এ সুপারিশের প্রতিও সরকার ও জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন :

কিন্তু এসব সত্ত্বেও বাংলা হরফ পরিবর্তন সম্পর্কিত পাকিস্তান সরকারের চক্রান্ত আরও কিছুদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদের একটি প্রস্তাব অনুযায়ী শাসনতান্ত্রিক মূল নীতিনির্ধারক কমিটি গঠিত হয়। উক্ত কমিটি ১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গণপরিষদে তাদের অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করে। এ রিপোর্টে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর সুপারিশ করা হয়। উক্ত সুপারিশের প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলায় তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়। মূলনীতি কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ও ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে “গণতান্ত্রিক ফেডারেশন” নামে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি আন্দোলন বিক্ষোভকে তীব্রতর করে তোলে। এভাবে পূর্ব বাংলার সর্বত্র কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে জনগণ সংগঠিত হতে শুরু করায় পাকিস্তান সরকার ভীত হয়ে পড়ে এবং ১৯৫০ সালের ২১ নভেম্বর রিপোর্টটি সম্পর্কে পরিষদীয় আলোচনা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | ১৯৫১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ ও কাজী মোতাহার হোসেনসহ বহুসংখ্যক শিল্পী সাহিত্যিক কবি, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক ও সরকারি কর্মচারিগণ পূর্ববাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীনের কাছে বাংলা ভাষাকে পরবর্তী ১ এপ্রিল থেকে সরকারি ভাষারূপে চালু করার জন্য একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এদিকে ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল তার কোনো কার্যকারিতা পরবর্তী কয়েক বছর আর থাকেনি। প্রতি বছরের মতো ১৯৫১ সালে ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়।

খালেক নেওয়াজ খানের সভাপতিত্বে এ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির নিষ্ক্রিয়তা সম্পর্কে বক্তাদের আলোচনার পর তা পুনর্গঠিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ঐ সভাতেই আবদুল মতিনকে আহ্বায়ক করে “বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” নামে একটি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির উদ্যোগে একটি স্মারকলিপি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্যদের কাছে এবং পাকিস্তানের সব পত্রিকাতে পাঠানো হয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | ১৯৫১ সালের ১৬ মার্চ কুমিল্লায় পূর্ব বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার পরিবর্তে উর্দু প্রবর্তনের চেষ্টাকে তীব্রভাবে নিন্দা করেন এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিটি বাঙালিকে বিদ্রোহ করার পরামর্শ দেন। ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলায় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নতুন প্রাণ চাঞ্চল্য দেখা দেয়। সারা পূর্ব বাংলায় নববর্ষ রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে একের পর এক বইমেলা ও সাংস্কৃতিক সভা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষার ওপর গুরুত্ব আরোপ ও বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মূল্যায়নের প্রচেষ্টা। আসলে পূর্ব বাংলার জনগণ বাংলা ভাষীর দিক থেকে উর্দুর চেয়ে সংখ্যাধিক্যে অনেক বেশি সংখ্যক হওয়ার পরও পাকিস্তান সরকারের অন্যায় আচরণের কারণে বাঙালিরা ফুঁসে উঠতে থাকে। ১৯৫১ সালে ভাষার ভিত্তিতে পাকিস্তানের জনগণের শতকরা হার ছিল নিম্নরূপ :

ভাষাশতকরা হার
বাংলা৫৬.৪০%
পাঞ্জাবী২৮.৫৫%
সিন্ধি4.89%
পশতু৩.৪৮%
উর্দু৩.২৭%
বেলুচি১.২৯%
ইংরেজি০.০২%
অন্যান্য১.৫২%
মোট১০০%

ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায় :

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সর্বশেষ পর্যায় ও চূড়ান্ত পরিণতির বছর। ভাষা আন্দোলনের কথা শুনলে আমরা মূলত ১৯৫২ সালের কথাই স্মরণ করি। ‘৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে আছে বেশির ভাগ বাঙালির কাছে। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ছাত্র-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীমহল তথা শিক্ষিত সমাজ ছাড়া আমজনতার সমর্থন মিলেনি, বরং কোনো কোনো এলাকার জনসাধারণ ব্যাপক বিরোধিতাই করেছে, সেই একই প্রশ্নে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দুনিয়া কাঁপানো একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিয়েছে বাঙালি জাতি।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | এর মূল কারণ ১৯৪৭ এ কয়েকটি বছর একদিকে মুসলিম লীগ সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বিশ্বাসঘাতকতার এবং অপরদিকে জনগণের স্বপ্ন ও নিদ্রাভঙ্গের কাল। ‘৫২ তে এসে কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদে ব্যবসায়ী, পেশাজীবী শ্রেণি আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে আসে। আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন ছাত্র, শিক্ষক, যুবক ও বুদ্ধিজীবী মহল। এ আন্দোলনের ঘটনাক্রম ছিল নিম্নরূপ :

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকায় শুরু হয় নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের অধিবেশন। এ উপলক্ষে ২৭ জানুয়ারি পল্টনে মুসলিম লীগের এক জনসভাও অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতির ভাষণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন তাঁর পূর্বসুরিদের মতোই আবার ঘোষণা করেন : “পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।” ছাত্রসমাজ তাঁর এই দম্ভোক্তিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং প্রতিবাদে ৩১ জানুয়ারি তারিখে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘটের ডাক দেয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট পালন শেষে ৩১ জানুয়ারি বিকেলেই পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী মুসলিম লীগের সহযোগিতায় ঢাকা বার লাইব্রেরিতে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে এক সর্বদলীয় সমাবেশের ব্যবস্থা করে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত এ সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদসহ অপরাপর রাজনৈতিক এবং ছাত্রসংগঠনও যোগদান করে। সভায় সর্বসম্মতভাবে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এর আহ্বায়ক নিযুক্ত হন আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা কাজী গোলাম মাহবুব। সদস্যদের অন্যতম ছিলেন মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম, আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল মতিন ও খালেক নেওয়াজ খান।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন :

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সারাদেশে আন্দোলন গড়ে তোলে। পরিষদ ৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ব ঘোষিত ছাত্র ধর্মঘটের প্রতি অর্থন এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, সভা বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করে। কর্মসূচি অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং ধর্মঘটের পর প্রায় দশ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর বিশাল মিছিল বের হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলা পরিষদের পরবর্তী অধিবেশনের দিনক্ষণ সরকারিভাবে ঘোষিত হলে ৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি সভায় একুশে ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী এক সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | এ সভায় মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিমসহ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অনেক সদস্য উপস্থিত থাকেন এবং ভাষার দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্প ঘোষণা করেন। প্রতিবাদ কর্মসূচির অংশ হিসেবে গৃহীত ২১ ফেব্রুয়ারিতে সারাদেশে সর্বাত্মক হরতালের প্রস্তুতি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে থাকে। জনমতের এ ধরনের প্রাবল্যের কাছে নিজেকে অসহায় মনে করে সরকার ২০ শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬ টায় একটানা ১ মাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র হরতাল, সভা-সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদির অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারী করেন।

এ সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ঢাকা শহরের রাজনৈতিক অঙ্গনে কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা দেয়। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বিক্ষোভের সঞ্চার হওয়ায় শহরে একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। এভাবে আস্তে আস্তে ভাষা আন্দোলন একটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে চরম পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ইতোমধ্যে ১৪৪ ধারা জারীর প্রেক্ষিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এক বৈঠকে মিলিত হয়। আবুল হালিমের নেতৃত্বে পরিচালিত এ বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক হয়। অধিকাংশ সদস্য মত প্রকাশ করেন : আমরা যদি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করি তাহলে দেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে সরকার জরুরী অবস্থার অজুহাতে সাধারণ নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে। আমরা সরকারকে সে সুযোগ দিতে চাই না। পরে ১১-৪ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু সংগ্রামী ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সভা, সমাবেশ ও বিক্ষোভ-মিছিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | পরদিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ১৪৪ ধারা ও পুলিশের যাবতীয় বাধা-নিষেধ উপেক্ষা করে ঢাকা শহরের ছাত্ররা দলে দলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় জমায়েত হতে থাকে। ছাত্রনেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের বটতলায়/আমতলায় /বেলতলায় (একই স্থানের বিভিন্ন নাম) যে সভা শুরু হয় যেখানে ছাত্রনেতা আবদুল মতিনের প্রস্তাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শোভাযাত্রাসহ প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে যাবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেলা প্রায় ২টা পর্যন্ত মিছিল করে ছাত্ররা বীরত্বের সঙ্গে গ্রেফতার বরণ করতে থাকে, আর ক্ষণে ক্ষণে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিকেল কলেজ ও মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের গেটে জমায়েত হয়ে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করতে থাকে। ছাত্ররা স্লোগান নিয়ে রাস্তায় বের হলেই পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বেলা তিনটায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এ সময় প্রাদেশিক পরিষদের সভার পূর্ব মুহূর্ত। ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে তা অনতিবিলম্বে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছাত্রাবাসে ছড়িয়ে পড়ে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | পুলিশ কয়েকবার ছাত্রদের ওপর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে তাড়া করতে করতে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ছাত্রাবাসগুলোতে ঢুকে পুলিশ ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করায় উত্তেজনা শতগুণ বৃদ্ধি পায়। প্রতিরোধে ছাত্ররাও পুলিশের ওপর ইট-পাটকেলসহ ঝটিকা আক্রমণ শুরু করে। আক্রমণের প্রচণ্ডতায় দিশেহারা হয়ে আনুমানিক বেলা ৪টার দিকে পুলিশ মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের সামনে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র রফিক উদ্দিন আহমদ ও গাঁও পাঁচুয়ার দর্জি আবদুল জব্বার শহীদ হন।

এইগুলোর আওয়াজ শুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র আবুল বরকত মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের শেডের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন। একটি বুলেট এসে তার উরুদেশ বিদ্ধ করে। প্রচুর রক্তপাতের পর বরকত রাত ৮টায় হাসপাতালে প্রাণ ত্যাগ করেন। এ ঘটনায় কম-বেশি আহত হন প্রায় ৬০ জন ছাত্র। এদের অধিকাংশকেই প্রাথমিক চিকিৎসার পর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। ২১ ফেব্রুয়ারিতে নিহতের সংখ্যা ছিল তিন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | এ তিনজন ছাত্রের লাশ তাঁদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফেরত না দিয়ে ঐ রাতেই পুলিশের তত্ত্বাবধানে আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হয়েছিল। এজন্য ২২ তারিখ সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে একুশের শহীদদের গায়েবি জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। সে জানাযায় কয়েক লাখ লোকের সমাবেশ ঘটে।

ঢাকায় এত বিরাট জনসমাবেশ এ প্রথম। জানাযা শেষে বিরাট শোক মিছিল বের করা হয়। কিন্তু মিছিলের ওপর পুলিশ আবার গুলিবর্ষণ করলে আরো কয়েকজন হতাহত হয়। এ দুদিনে যারা নিহত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে সাতজন সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে জানা গেছে। উপরে উল্লিখিত তিনজন আর ৪. আবদুস সালাম (সরকারি অফিসের পিয়ন), শফিউর রহমান (হাইকোর্টের কর্মচারি), আবদুল আউয়াল (১০-১১ বছরের বালক) ও অহিদুজ্জামান (৯- ১০ বছরের বালক) ভাষা শহীদদের রক্তে যেদিন ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়ে গেল।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | পুলিশের গুলি ও ছাত্র হত্যার খবর ঢাকার পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে সব পেশার মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে। সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সুপারিশ করে এক প্রস্তাব পাশ করে। প্রস্তাবটি পেশ করেন প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন। ২২ ফেব্রুয়ারির মতো ২৩ ফেব্রুয়ারিতেও ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। দোকানপাট, অফিস ও যানবাহন চলাচল একেবারে বন্ধ থাকে। নারায়ণগঞ্জে একটি জনসভা ও অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব বাংলার সর্বত্র ছাত্র, শ্রমিক, কর্মচারিসহ জনগণের ব্যাপক অংশ ধর্মঘটে যোগদান করে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন :

গ্রামাঞ্চলেও ঢাকার গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৩ তারিখ রাতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি একটি শহীদ স্মৃতিসৌধ বা শহীদ মিনার নির্মাণ। এ শহীদ মিনার ঠিক সে স্থানটিতেই নির্মিত হয়েছিল, যেখানে মাথায় গুলি লেগে ছাত্রকর্মী রফিক আহমেদ প্রথম শহীদ হন। ২৬ মার্চ পুলিশ মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে অভিযান চালিয়ে শহীদ মিনারটিকে ধ্বংস করে। ভাষা আন্দোলনের এ পর্যায়ে পূর্ব বাংলাব্যাপী ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডের পর পূর্ব বাংলার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সর্বত্র ধর্মঘট, মিছিল ইত্যাদির মাধ্যমে পুলিশী জুলুম ও সরকারের ভাষানীতির বিরুদ্ধে একটানা বিক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। সকল বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী ও নেতাগণ এসব বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। এজন্য আন্দোলনে একটু ভাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকা এবং অন্যান্য জেলায় অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করা হয় এবং অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। মাওলানা ভাসানী ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে তাঁর গ্রামের বাড়িতে গ্রেফতার করে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

চরম দমনপীড়ন ও গ্রেফতারের মাধ্যমে আন্দোলন স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সরকারের কঠোর দমননীতি ও ধরপাকড়ের ফলে সংগ্রাম পরিষদের নেতারা আত্মগোপন করে এবং সাধারণ ছাত্রদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন | পরবর্তী বছর ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার ভেতর দিয়ে পালন করা হয় ২১ ফেব্রুয়ারি। একুশের প্রভাবে পূর্ব বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতি নতুন চেতনায় জেগে উঠে। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় একুশের প্রথম সংকলন গ্রন্থ “একুশে ফেব্রুয়ারি।” এরপর আসে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি ইশতেহারে অন্যতম একটি দফা ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান।

শেষ পর্যন্ত ছাত্র জনতার দাবীর কাছে মাথানত করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এরপর ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০ তম অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এখন বিশ্বের প্রতিটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করছে প্রতিবছর। মহান একুশের এ বিশ্বায়ন আমাদের বাংলা ভাষা আন্দোলন ও সংগ্রামকে গোটা বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়েছে যা বাংলাদেশের জন্য পরম গৌরবের।

আরো পড়ুুন:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You're currently offline !!

error: Content is protected !!