স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে যুক্তি | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি যখন ভারতবর্ষ থেকে তাদের ঔপনিবেশিক শক্তি গুটিয়ে নিচ্ছিলেন তখন এ অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী স্বাধীনতার বিষয়টি নানা পক্ষ থেকে নানাভাবে উপস্থাপিত হতে থাকে।
এমনি এক রাজনৈতিক পটভূমিতে সোহ্রাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম ‘স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসেন। ১৯৪৭ সালের ২৯শে এপ্রিল এক সংবাদ বিবৃতিতে আবুল হাশিম বলেন, লাহোর প্রস্তাবের প্রতিই ভারতের মুসলমানগণ আনুগত্য স্বীকার করে। এই প্রস্তাবে অখণ্ড মুসলিম রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ছিল না।… ইহাতে বাংলা এবং ভারতের অন্যান্য সাংস্কৃতিক ইউনিটকে পূর্ণ সার্বভৌমত্ব প্রদানের কথা বলা হয়।
তিনি বাংলার হিন্দু-মুসলিম যুব সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘তাদের দেশকে’ বাইরের সকল প্রকার শৃঙ্খলমুক্ত করার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন যে, বাংলার হিন্দু ও মুসলমানগণ তাদের পৃথক সত্তা বজায় রেখে এক চমৎকার অভিন্ন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য গড়ে তুলেছেন…। ভারতবাদ হতে মুক্ত বাংলার হিন্দু ও মুসলমানগণ তাদের নিজেদের ব্যাপারে নিজেরাই শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা করতে পারবে।
বাংলাবিভক্তির দাবির পশ্চাতে সক্রিয় হিন্দু মনমানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি। এ দাবির অযৌক্তিকতা, ‘বাংলাবিভক্তির পরিণতি’,
বাংলার ঐক্যবদ্ধ থাকার অপরিহার্যতা, স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্রে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক এবং এ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে সোহরাওয়ার্দী এক দীর্ঘ বক্তব্য পেশ করেন। হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের বাংলাবিভক্তির দাবিকে অদূরদর্শী এবং ‘পরাজিতের মানসিকতা’ বলে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন যে, ১৯৩৭ সাল থেকে বাংলার হিন্দুরা তাদের সংখ্যা, সম্পদ, শিক্ষা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির তুলনায় বঙ্গীয় মন্ত্রিসভায় আসন লাভ করতে না পারায় তা থেকে সৃষ্ট হতাশাই উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে যুক্তি :
বাংলার হিন্দুদের ঐ অবস্থার মূল কারণ হিসেবে প্রধানত সর্বভারতভিত্তিক হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের কথা তিনি উল্লেখ করেন, যেখানে সব ধরনের সমস্যা সর্বভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত হয়ে থাকে। প্রত্যেকটি প্রদেশ নিজ ব্যাপারে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করলে পুরোপুরি ভিন্ন এক অবস্থার উদ্ভব হবে’ এ আশাবাদ ব্যক্ত করে সোহরাওয়ার্দী বলেন, ‘স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রে আমরা সবাই এক সঙ্গে বসে এমন একটি সরকারব্যবস্থা প্রণয়ন করতে সক্ষম হবো, যা সকলের সন্তুষ্টি বিধান করতে পারে।’
১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে ‘ভয়াবহ কলকাতা দাঙ্গার’ অব্যবহিত পরে পূর্ব বাংলার নোয়াখালী জেলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়, যাতে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্তরাই অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ‘নোয়াখালী দাঙ্গা’কে অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রে হিন্দুদের সম্ভাব্য অবস্থার একটি নজির হিসেবে কোনো কোনো মহল তুলে ধরার চেষ্টা করলে সোহ্রাওয়ার্দী তা খণ্ডন করে হিন্দু সম্প্রদায়কে স্মরণ করিয়ে দেন যে, নোয়াখালী ছাড়া বাংলার আরও বহু জেলা রয়েছে, যেখানে মুসলমানরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও উভয় সম্প্রদায় বহুকাল ধরে শান্তি ও পারস্পরিক সৌহার্দ্যের মধ্যে বসবাস করে আসছে।
‘বাংলাবিভক্তি হিন্দুদের জন্যও আত্মহত্যার শামিল হবে’-এ অভিমত ব্যক্ত করে তিনি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন যে, ‘অর্থনৈতিক ঐক্য, পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং একটি কার্যকর শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের আবশ্যকতা’ বিবেচনায় বাংলা সর্বদাই অবিভাজ্য। তিনি বাঙালি-অবাঙালি প্রশ্ন তুলে কীভাবে এক শ্রেণির অবাঙালি কর্তৃক বাংলা শোষিত হচ্ছে সে কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘বাংলাকে সমৃদ্ধশালী হতে হলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে…বাংলাকে অবশ্যই তার ধন-সম্পদ এবং নিজ ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হতে
হবে।’
বাংলা ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন হলে এর ভবিষ্যৎ চিত্র কেমন হতে পারে তার ইঙ্গিত দিতে গিয়ে সোহরাওয়ার্দী বলেন এটা বস্তুত একটি মহান দেশে পরিণত হবে, ভারত উপমহাদেশে যা হবে সবচেয়ে সমৃদ্ধ। এখানে জনগণ উন্নত জীবন ধারণের সুবিধা নিয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে সমৃদ্ধি অর্জন করে কালক্রমে এ দেশ বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জন করতে সমর্থ হবে। সোহরাওয়ার্দী এ মর্মে আরও অভিমত ব্যক্ত করেন যে, হিন্দু ও মুসলমানরা সম্মিলিতভাবে বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সক্ষম হলে এক সময়ে বাংলার সঙ্গে তৎসংলগ্ন ও বিহর প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত মানভূম, সিংহভূম ও পূর্ণিয়া জেলা এবং আসাম প্রদেশের সুরমা এলাকার সংযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দেশবিভাগকে কেন্দ্র করে দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান হলে আসামের বাকি অংশ বাংলার সঙ্গে একীভূত হয়ে একক রাষ্ট্র গঠনে এগিয়ে আসবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এটাই ছিল সোহ্রাওয়ার্দীর ‘বৃহত্তর বাংলা’ রাষ্ট্রের ধারণা।
স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠন সম্পর্কে সোহরাওয়ার্দীর দিল্লি ঘোষণার দু’দিনের মধ্যে ২৯ এপ্রিল আবুল হাশিম এক বিবৃতিতে এ পরিকল্পনার সপক্ষে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরে বাংলাবিভক্তির আন্দোলনে মদদ দানের জন্য বিদেশি পুঁজি এবং ভারতীয় দোসরদের দায়ী করেন।
তিনি হিন্দুদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, তারা (হিন্দুরা) বাংলার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক এবং হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো এক সম্প্রদায়ের পক্ষে অপরকে পদানত করে রাখা সম্ভব নয়। অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলির প্রকৃতি কেমন হবে সে সম্পর্কে সোওয়ার্দী সুস্পষ্ট মতামত দানে বিরত থাকলেও হাশিম হিন্দুদের উদ্দেশ্যে যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং প্রশাসনে তাদেরকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ (১৯২৩) অনুযায়ী ৫০: ৫০ আসন প্রদানের কথা ঘোষণা করেন।
হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাংলার যুব সম্প্রদায়ের প্রতি এক আবেগপূর্ণ আবেদনে তিনি মন্তব্য করেন যে, ‘উদ্ভূত সঙ্কট নিরসনের পন্থা হচ্ছে গভীর দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন করা, একে বিভক্ত করা নয়।’
আরো পড়ুুন:
- স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস
- লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ
- লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব
- লাহোর প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্যসমূহ
- ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের সংশোধন
- লাহোর প্রস্তাবের মূল আলোচ্য বিষয়
- ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি
- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাঃ দ্বিতীয় পর্ব
- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাঃ প্রথম পর্ব
- ভূগোল, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
- মৌর্য বংশ – প্রাক সুলতানী আমল
- মুঘল আমল – সাধারন জ্ঞান
- সুলতানী আমল – মুসলিম রাজত্ব
- মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য এবং মুসলিম কবি ও শাসকদের অবদান
- পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর পরিবর্তে কেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে?