দুই পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য

দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য | ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের মধ্যরাতে উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান ঘটে রক্তপাত, পারস্পরিক ঘৃণা ও ধর্মীয় ছলনাময়ী তথাকথিত ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’-এর ভিত্তিতে; সৃষ্টি হয় ‘পাকিস্তান’ ও ‘ভারত’ নামের দুটো রাষ্ট্র। ভারতবর্ষের বিভাজনের কোলাহলের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া, অযোগ্য রাজনীতিবিদ ও অপরিণামদর্শী সমরনায়কদের নেতৃত্বে খুঁড়িয়ে চলা, জিন্নাহের সৃষ্টি, অস্বাভাবিক ও মৃতপ্রায় রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান বিশ্ববাসীর কাছে আত্মপ্রকাশ করে। ভারতবর্ষের বিভাজনে বাংলা ভূখণ্ডটি বিভক্ত হয়ে পড়ে পূর্ব ও পশ্চিম অংশে।

পূর্ব-বাংলায় থেকে যায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম-বিভাগ, রাজশাহী-বিভাগের রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী ও পাবনা জেলা, প্রেসিডেন্সি বিভাগের খুলনা জেলা, চারটি থানা ছাড়া সিলেট; আর নদীয়া, যশোর, পশ্চিম-দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি ও মালদা অঞ্চলকে অঙ্গচ্ছেদ করা হয়। বাঙালি অনেক সম্ভব-অসম্ভবের বুক-বাঁধা আশা নিয়ে, জিন্নাহর উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলিম উৎপীরণের মিথ্যা অভিযোগ মেনে নিয়ে অস্বাভাবিক ও ‘ধর্মভিত্তিক’ পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হয়।

এখনো amarStudy অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপটি ডাউনলোড না করে থাকলে গুগল প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপটি ইন্সটল করতে এখানে যানঃ Download Now. অ্যাপটি বিসিএস’সহ প্রায় সব রকমের চাকুরির প্রস্তুতির সহায়ক।

৪ কোটি ২০ লক্ষ বাঙালি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল এলাকা পেলেও হারায় তার জন্মভূমির বিশাল অঞ্চল-হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগরের আধিপত্যতা, এবং বিচিত্র্য বৈচিত্র্য মাটি ঘেঁষা সংস্কৃতি ও গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-বরাকের ঐতিহ্য। বস্তুতপক্ষে সৃষ্টিলগ্ন থেকেই অস্বাভাবিক ও ‘ধর্মভিত্তিক’ পাকিস্তানের পশ্চিম ও পূর্ব দুটো ভূখণ্ডের সমন্বয়ে ১,২০০ মাইল ভারত ভূখণ্ড দ্বারা ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত ও ইসলামি ঐক্যে সংযুক্ত রাষ্ট্রের-পূর্ব ও পশ্চিম অংশের স্পর্শকাতর সম্পর্কে উন্নতির চেয়ে অবনতিই বেশি ঘটে। নিম্নে পাকিস্তান শাসন আমলে সৃষ্ট পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য তুলে ধরা হলো :

দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য | ক. অর্থনৈতিক বৈষম্য : ১৯৭০ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ শীর্ষক একটি পোস্টারে অর্থনৈতিক বৈষম্যের আরও কিছু ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে জনসংখ্যার দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান বৃহত্তর অংশ হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে রাজস্ব ব্যয় ছিল তিন গুণেরও বেশি। চাল, আটা ও তেলের দাম পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে ছিল দ্বিগুণ। কেন্দ্রীয় সরকার ও সামরিক বিভাগের চাকরির প্রায় পুরোটাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের দখলে।

অর্থনৈতিক বৈষম্যের এ চিত্র পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে পীড়া দেয়। পাকিস্তানের দু অংশের মধ্যে এ চরম আর্থসামাজিক বৈষম্যের কারণেই বেগবান হয়েছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলনের সুদৃঢ় আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যেসব আন্দোলন দানা বাঁধে সেগুলোর পেছনে বাঙালির অর্থনৈতিক বঞ্চনার অনুভূতি সক্রিয় ভূমিকা রাখে। পাকিস্তান আমলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আরও যেসব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :

০১। রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য : ১৯৫২-১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয় পূর্ব-বাংলায়, কিন্তু পশ্চিম-পাকিস্তানে তা দেখা দেয়নি, বরং ১৯৪৮-১৯৫৩ সময়সীমায় পশ্চিম-পাকিস্তানের কাছে পূর্ব-বাংলা দ্রব্য আমদানিখাতে ৯০ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা ঋণ করে। পশ্চিম-পাকিস্তানের ১৯৫৩-৫৪ (নয় মাস) সময়সীমায় পূর্ব-বাংলার ওপর থেকে বাণিজ্যখাতে ১৬ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা আদায় করে।

নিখিল পাকিস্তানে নানারকম প্রকল্পের জন্য নানাসময়ে যে ব্যয়ধার্য করা হয় তা থেকেও স্পষ্টই দেখা যায় দুই অঞ্চলের মধ্যে বিরাজমান আর্থিক ব্যবধান কী পরিমাণের ছিল। পূর্ব-বাংলা থেকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ও সমরনায়করা মোট রাজস্বের এক-চতুর্থাংশের চেয়ে কম, উন্নয়ন বাজেটের এক-তৃতীয়াংশের চেয়ে কম, সর্বপণ্যের এক-চতুর্থাংশ এবং বৈদেশিক সাহায্যের এক-পঞ্চমাংশ পেয়ে থাকে।

দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য | তবে বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় পুরোটাই আসে পূর্ব-বাংলার পাট থেকে। অবশ্যই এক অপেক্ষাকৃত দরিদ্র অঞ্চল সাধারণত দেয় অল্প
তাই পায়ও কমই, কিন্তু পূর্ব-বাংলার ক্ষেত্রে তা উল্টো। পূর্ব-বাংলার দ্রব্যমূল্য আকাশ ছোঁয়া, যেমন চালের দাম পশ্চিমাংশের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ, চাকরির ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার দখলে মাত্র ১৫-ভাগ এবং সেনাবাহিনীতে ১০-ভাগ। আরও উদাহরণ উল্লেখ করা যায় ১. ১৯৪৮-১৯৫০ পশ্চিম-পাকিস্তানের জন্য ৮৮ কোটি রুপি ও পূর্ব বাংলার জন্য ২৫ কোটি রুপি।

০২। ১৯৫০-১৯৫৫ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ১,১২৯ কোটি রুপি ও পূর্ব-বাংলার জন্য ৫২৪ কোটি রুপি।

০৩। ১৯৫৫-১৯৬০ পশ্চিম-পাকিস্তানের জন্য ১,৬৫৫ কোটি রুপি ও পূর্ব-বাংলার জন্য ৫২৪ কোটি রুপি।

০৪। ১৯৬০-১৯৬৫ পশ্চিম-পাকিস্তানের জন্য ৩,৩৫৫ কোটি রুপি ও পূর্ব-বাংলার জন্য ১,৪০৪ কোটি রুপি।

০৫। ১৯৬৫-১৯৭০ পশ্চিম-পাকিস্তানের জন্য ৫,১৯৫ কোটি রুপি ও পূর্ব বাংলার জন্য ১,১৪১ কোটি রুপি বরাদ্দ করা হয়।

খ। বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য : ১৯৫০-৭০ কালপর্বে বেসরকারি খাতে উন্নয়নব্যয়ের শতকরা ৭৭ ভাগ নির্বাহ করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৫০-৭০ সময়কালে মোট উন্নয়নব্যয়ের শতকরা ৪৮ ভাগ বেসরকারি খাতে নির্বাহ করা হয় বিধায় (পশ্চিম পাকিস্তানে ৫১% এবং পূর্ব পাকিস্তানে ৩২%) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিনিয়োগ বৈষম্যের মূল উৎস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের বেসরকারি খাত।

পূর্ব পাকিস্তানে বেসরকারি খাতের যে আপেক্ষিক দুর্বলতা আমরা লক্ষ্য করেছি, তা দু অঞ্চলের ভিন্ন রকম উত্তরাধিকারের অংশ। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে কোথাও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় ব্যবসায়িক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী ছিল না। সিন্ধুতে ব্যবসা-বাণিজ্য সবই হিন্দুরা নিয়ন্ত্রণ করত। পাঞ্জাবের ব্যবসা-বাণিজ্যে শিখ ও হিন্দুর প্রাধান্য ছিল।

চামড়ার ব্যবসার সাথে যুক্ত পাঞ্জাবি মুসলিম চিনিওটিরা পাঞ্জাবের বাইরে ব্যবসা করতে পছন্দ করত। বাংলায় বাঙালি মুসলিমরা সকল পর্যায়ের ব্যবসা-বাণিজ্যে অনুপস্থিত ছিল । সুতরাং ভারত থেকে আগত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়গুলোই ব্যবসা-বাণিজ্যের পাল্লা পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে ভারী করে তোলে।

দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য | গ। শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈষম্য : ১৯৪৮-৪৯ সালে উভয় অঞ্চলের শিল্পক্ষমতাই ছিল নগণ্য এবং বস্ত্র-উৎপাদন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সমপরিমাণ ছিল। সিগারেট ও সিমেন্ট উৎপাদনে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা ছিল সামান্য। পূর্ব পাকিস্তান ছিল বড় রকমের চা-উৎপাদনকারী। ১৯৪৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের কলকারখানায় নিয়োজিত কর্মীসংখ্যা ছিল ১১৭,৩৫৫ জন, আর পূর্ব পাকিস্তানে এদের সংখ্যা ছিল ৫৫,০৭৪ জন।

১৯৫৪ সাল নাগাদ পশ্চিম পাকিস্তানে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়। সেখানে চাকুরিরত লোকের সংখ্যা প্রায় ৮৮ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এ সময় পূর্ব পাকিস্তানে তা বৃদ্ধি পায় মাত্র ৩৩ হাজার। পশ্চিম পাকিস্তানে বৃহদায়তন শিল্পউৎপাদন ১৯৪৯-৫০ সালের ২১ কোটি টাকা থেকে দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ৫৯ কোটি ৫০ লক্ষ টাকায় পৌঁছে।

পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানে তা ৩ কোটি ৮০ লক্ষ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭ কোটি ৫০ লক্ষ টাকায় দাঁড়ায়। পশ্চিম পাকিস্তানে সুতার উৎপাদন ১৯৪৮-৪৯ সালের ১ কোটি ৮০ লক্ষ পাউন্ড থেকে ১৯৫৪-৫৫ সালে ২৫ কোটি ২০ লক্ষ পাউন্ডে উপনীত হয় এবং বস্ত্রের উৎপাদন একই সময়ে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ গজ থেকে ৩৮ কোটি ৯০ লক্ষ গজে বর্ধিত হয়।

ঘ। বাণিজ্যিক লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য : ১৯৫১ সালে জানুয়ারি থেকে ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে দেখা যায় যে, পাকিস্তান সরকার ১১০ কোটি ৪০ লক্ষ টাকার বাণিজ্যিক আমদানি লাইসেন্স বরাদ্দ করেছে এবং তার ৬৭% পেয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানি আমদানিকারকরা। এসব লাইসেন্স শিল্পে বিনিয়োগের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের হাতে প্রচুর সম্পদ এনে দেয়।

ঙ। বৈদেশিক সাহায্য ভোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য : ১৯৫০-এর দশকের শেষদিক থেকে পাকিস্তান তার উন্নয়ন তৎপরতা অব্যাহত রাখার জন্য বৈদেশিক সাহায্যের ওপর ক্রমেই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান ৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ঋণ ও মঞ্জুরি পায়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত পাকিস্তানকে প্রদত্ত ৭.৬ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক অর্থনৈতিক সাহায্য থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রায় ২.০২ বিলিয়ন ডলার (২৬.৬%)। ১৯৪৭-৭০-এর মধ্যে প্রদত্ত তহবিলের প্রায় ৬.৪ বিলিয়ন ডলার কাজে লাগানো হয়। তা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে কাজে লাগানো ১.৯ বিলিয়ন ডলার (৩০%)।

দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য | চ। উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য : পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানে সরকারি খাতে যে উন্নয়ন ব্যয় হয় তার মাত্র ২৪ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়ে। তাই ঋণ রেয়াতিতে এ প্রদেশের খুব বেশি লাভ হলো না। তবে ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের হিস্যা হয় ৩৪ শতাংশ। কিন্তু বাষট্টি সালের পর আর কোনো ঋণ রেয়াতি না দেয়ায় পূর্ব পাকিস্তানকে ঋণের ভারি বোঝা বইতে হয়। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে উন্নয়ন বাজেটের প্রায় সম্পূর্ণ বরাদ্দই ঋণ হিসেবে দেয়া হতো।

কিন্তু পশ্চিমের উন্নয়ন ব্যয়ের বিরাট অংশ অনুদান বা বিনাসুদে ঋণ হিসেবে দেয়া হতো। পাকিস্তানের তেইশ বছরের উন্নয়ন বাজেটের ২৮ শতাংশ পশ্চিমে খরচ করা হয়। কিন্তু সহজ শর্তে সম্পদ পেত বলে ১৯৬২ সালের পর পশ্চিমের ঋণের বোঝা সবসময় পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে কম ছিল। উন্নয়নপ্রকল্পের ক্ষেত্রে আইয়ুব শাসনামলের ব্যয় ধার্য করার চিত্রটি হচ্ছে

০১. বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা: পশ্চিম-পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হয় ৮০% এবং পূর্ব-বাংলার জন্য ২০%।

০২। মার্কিন সাহায্য: পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয় ৬৬% ও পূর্ব-বাংলায় ৩৪%।

০৩। শিল্পোন্নয়ন কর্পোরেশন: পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয় ৫৮% ও পূর্ব-বাংলায় ৪২%।

০৪। শিল্প ঋণ ও বিনিয়োগ: পশ্চিম-পাকিস্তানে ব্যয় করা হয় ৮০% ও পূর্ব-বাংলায় ২০%।

০৫। শিল্পোন্নয়ন ব্যাংক: পশ্চিম-পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ করা হয় ৭৬% ও পূর্ব-বাংলায় ২৪%।

০৬। গৃহ-নিৰ্মাণ: পশ্চিম-পাকিস্তানের জন্য ব্যয় করা হয় ৮৮% ও পূর্ব-বাংলায় ১২%।

০৭। কৃষি বিকাশঃ কৃষি বিকাশের ক্ষেত্রে পশ্চিম-পাকিস্তানে বরাদ্দ করা হয় ২২ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা (সিন্ধু প্রদেশ ৬০ লক্ষ, সীমান্ত প্রদেশ ৪ কোটি ৫২ লক্ষ, বেলুচিস্তান শূন্য ও বাদবাকি পাঞ্জাবের জন্য) আর পূর্ব-বাংলার ভাগে ১৯.৪ শতাংশ।

ছ। মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য : ১৯৪৯-৫০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের পূর্বাংশের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি ছিল। কিন্তু ১৯৫৪-৫৫ তে এ ব্যবধানের হার আরও বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৯.৪৬ শতাংশ। আর এ বৈষম্যমূলক প্রবৃদ্ধির পেছনে শুধু প্রাক্ বিভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চতর অর্থনৈতিক বিকাশস্তরই দায়ী ছিল না, পরবর্তীকালে অনুসৃত নানারকম বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক নীতিও এ ব্যবধান বা বৈষম্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সক্রিয় অবদান রেখেছিল।

জ। কৃষিকর্মে প্রযুক্ত কলাকৌশলগত বৈষম্য : পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরুতে পূর্ব-বাংলায় যান্ত্রিক চাষাবাদের কোনোরকম ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি ১৯৫৩ সালে যখন একটি জরিপ অনুষ্ঠিত হয় তখন সরকারি অফিস প্রদর্শনীর জন্য দু-একটি পাওয়ার টিলার ছোট কলের লাঙল কিংবা ট্রাক্টর থাকলেও চাষাবাদের জন্য কোনো যন্ত্রকৌশল ব্যবহৃত হত না। চিরায়ত গতানুগতিক কলাকৌশলই ছিল পূর্ব বাংলার কৃষিকর্মের একমাত্র হাতিয়ার।

অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে আগে থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হয়ে এসেছে এবং ১৯৪৬ সাল থেকেই ব্যাপকভাবে ট্রাক্টরের মাধ্যমে চাষাবাদ শুরু হয়ে গেছে।

দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য | ঝ। বাণিজ্য ক্ষেত্রে বৈষম্য : বাণিজ্যক্ষেত্রে জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তানের দু অংশের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য ছিল। এ আলোচনা আমরা দু-একটি উদাহরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন কিংবা যাত্রী পরিবহন ব্যবসার কেন্দ্র ছিল করাচি ও বোম্বাই। পাকিস্তানের জন্মের পর যে ৮টি মুসলিম ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান পাকিস্তানের মধ্যে আমরা দেখি সেখানে ৭টিই করাচিকেন্দ্রিক।

এ ৭টি প্রতিষ্ঠানের মোট ৩০টি বৃহৎ আকারের পণ্যবাহী সমুদ্রযান ছিল- এদের মোট মালপরিবহন ক্ষমতা ছিল ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ৯৩৭ মেট্রিক টন। এ প্রতিষ্ঠানগুলো বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের গোড়া থেকেই এ ব্যবসা করে আসছে। অন্যদিকে, পূর্ব-বাংলার চট্টগ্রামে যে-প্রতিষ্ঠানটি ছিল তার শুরু ১৯৪৬ সালে এবং এর একমাত্র কার্গোটির মাল পরিবহন ক্ষমতা ছিল মাত্র ৫৬০ মেট্রিক টন। যদি মাল পরিবহন ক্ষমতাকে তুলনার মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করা যায় তাহলে এ বাণিজ্যের ভারকেন্দ্রের শতকরা ৯৯.৬ ভাগই ছিল করাচিতে আর চট্টগ্রামে ছিল মাত্র শতকরা ০.৪ ভাগ।

ঞ। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বৈষম্য : ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় সমগ্র পাকিস্তানে বিভিন্ন উৎস থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ছিল মোট ৭১,৩৫৮ কিলোওয়াট। পূর্ব বাংলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭,২৮৬ কিলোওয়াট অর্থাৎ মোট সরবরাহের মাত্র শতকরা ১০.২১ ভাগ। অপরদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ছিল ৬৪,০৭২ কিলোওয়াট অর্থাৎ মোট সরবরাহের শতকরা ৮৯.৭৯ ভাগ।

ট। সড়ক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বৈষম্য : দেশবিভাগের সমসাময়িককালের এক হিসেব থেকে দেখা যায় পাকিস্তানে উন্নত সড়কের দৈর্ঘ্য ছিল মোট ৮,৩৫২ মাইল। পূর্ব-বাংলায় ছিল মাত্র ৭৫৭ মাইল অর্থাৎ মোট উন্নত সড়কের মাত্র শতকরা ৯.০৬ ভাগ। সে তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে উন্নত সড়কের দৈর্ঘ্য ছিল ৭,৫৯৫ মাইল তথা মোট উন্নত সড়কের শতকরা ৯০.৯৪ ভাগ।

ঠ। কৃষি ব্যবস্থার বৈষম্য : পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীও পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকদের অন্যায় ও বৈষম্যের শিকার বানাল। পাকিস্তানের দু অংশের মাঝে এমনিতেই কৃষি ব্যবস্থায় ব্যাপক বৈষম্য ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে যান্ত্রিক চাষাবাদের কোনো রকম ব্যবস্থা ছিল না। চিরায়ত গতানুগতিক কলাকৌশলই ছিল এখানকার কৃষিকর্মের হাতিয়ারে পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানে ট্রাক্টরের মাধ্যমে চাষাবাদ শুরু হয়ে গেছে। ১৯৫০ সালের এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানে নিট কৃষি জমির শতকরা ২১ ভাগ যান্ত্রিক চাষের আওতায় এসে গেছে। পাকিস্তানি শাসনামলে কৃষিক্ষেত্রে যেসব নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তা পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকের পক্ষে যায়নি। খাস জমি বণ্টন, জমির সিলিং, বর্গাচাষিদের সঠিক প্রাপ্য, কৃষক অধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা ছিল না।

দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য | ড। বন্দর উন্নয়ন : সাতচল্লিশের বঙ্গভঙ্গের মুহূর্তে তখনকার গভর্নর আর. জি. কেসি মন্তব্য করেছিলেন যে, হিন্দু ও
মুসলমানদের ভেতর আসল পার্থক্যটা ধর্মতান্ত্রিক নয়, অর্থনৈতিক; মুসলমানরা যে পাকিস্তান চায় সে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে।
বক্তব্যটি যথার্থ। সেই সময়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন খণ্ডিত অবস্থায় পূর্ববঙ্গ অর্থনৈতিকভাবে টিকবে কি না, কেননা পূর্ববঙ্গের তো কোনো বন্দর নেই। কথা ছিল স্বাধীন পাকিস্তানে চট্টগ্রাম বন্দরকে দ্রুত গড়ে তোলা হবে। তা করা হয় নি। উন্নতি ঘটেছে অন্যত্র, প্রথমে বন্দরনগরি করাচিতে, পরে নতুন রাজধানী রাওয়ালপিণ্ডিতে। এটা একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। সর্বত্রই এমনটি ঘটেছে। এই বৈষম্যই অনিবার্য করেছে পাকিস্তানের ভাঙন। ভাঙতেই হয়েছে, কেননা শাসকদের মনোভাব ও নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসে নি। খ. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য : ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের দু’অঞ্চলের মধ্যে ব্যবধান ছিল নানা ক্ষেত্রে। ভৌগোলিক ব্যবধানের পাশাপাশি জীবন যাপন প্রণালী, খাদ্যাভাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘরবাড়ি, শিল্প-সংস্কৃতি ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই ব্যবধান ছিল। এর পাশাপাশি পশ্চিমাদের সীমাহীন শোষণ ও নিপীড়নের ফলে দু’অঞ্চলের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য তৈরি হয়। যা নিম্নে তুলে ধরা হলো:
১. মনন ও মেজাজের পার্থক্য : পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে বাংলার ভূপ্রকৃতিগত অমিলও অনেক। বাংলার ভূপ্রকৃতিতে নদীর গুরুত্ব সুস্পষ্ট, এমনকি বাঙালির মনমেজাজ, চিন্তাচেতনার আকৃতি-প্রকৃতি নির্ণয় করে বাংলার নদীগুলো। বাঙালি নদী ছাড়া যেমন বাঁচার . চিন্তা করতে পারে না তেমনি পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ নদী ছাড়াই জীবন চালায়। গঙ্গা-পদ্মা-ভাগীরথী, মেঘনা-যমুনা-মহানন্দা, সুরমা বারাক-কুশিয়ারা, ব্রহ্মপুত্র-ধলেশ্বরী-শীতলক্ষ্যা, অজয়-দামোদর-কাঁসাই, সরস্বতী-দ্বারকেশ-রূপনারায়ণ, তিস্তা-তিতাস-খোয়াই, করতোয়া-পূর্ণভবা-কর্ণফুলী, মনু-গড়াই-মধুমতী ইত্যাদি নদীর স্রোতধারাই বাঙালিকে দিয়েছে নিজস্ব ভৌগোলিক সত্তা, নিজস্ব ঐতিহাসিক সত্তা, যা অবাঙালি জনগোষ্ঠী কোনোদিনই বুঝতে পারে না, বোঝা তাদের জন্য সম্ভবও নয়।
২. ঐতিহ্য ও সভ্যতার ক্ষেত্রে পার্থক্য : পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত এই দ্বিধাবিভক্ত, অস্বাভাবিক ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের দুই অঞ্চলের মধ্যে ঐতিহ্য-সভ্যতা-সংস্কৃতি-কৃষ্টি-ভাষাতেও হাজার মাইলের দূরত্ব ব্যবধান। পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে বাংলার ঐতিহ্য সভ্যতার অমিলের কারণ-বাঙালির ঐতিহ্য-সভ্যতার অংশ হচ্ছে পাণ্ডুরাজার ঢিবি, তমলুক, চন্দ্রকেতুগ, জগজ্জীবনপুর, রাজবাড়ি-ডাঙ্গা, বাণগড়, গঙ্গারিটি, পুণ্ড্রবর্ধন, মহাস্থান, পাহাড়পুর, নোয়াপাড়া-ঈশানচন্দ্রনগর, ময়নামতী, লালমাই, মঙ্গলকোট, বারকান্তা প্রভৃতি । অঙ্গ বঙ্গ-মগধ-কলিঙ্গ-মুহ্ম-রাঢ়-পৌণ্ড্র-সমতট-হরিকেলের জনগোষ্ঠী দ্বারা বৃহৎ বাংলাঞ্চলে বা পূর্ব-ভারতবর্ষে একটি সুসংহত ও ঋদ্ধরাষ্ট্র সমাজ ব্যবস্থা, ঐতিহ্য-সভ্যতা গড়ে ওঠে।
৩. সঙ্গীত ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে পার্থক্য : হাজার হাজার বছর ধরে বাঙালির দেহমনে প্রবাহিত হতে থাকে যাত্রা, কবিগান, লোকগাথা, লোকগীতি, পল্লী-গীতি, সাঁওতালি মনিপুরী নৃত, হস্তশিল্প, মৃৎশিল্প, মসলিনশিল্প, শঙ্খশিল্প, বেতশিল্প, পটশিল্প, রেশমশিল্প, বস্ত্রশিল্প, দারুশিল্প, নৌকাদৌড়-নবান্ন-বৈশাখি-পৌষসংক্রান্তির উৎসব প্রভৃতি। এসব পশ্চিমাঞ্চলের ঐতিহ্য-সভ্যতার বহির্ভূত অংশ। ৪. কৃষ্টিগত পার্থক্য : অস্বাভাবিক ও ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি সংস্কৃতি-কৃষ্টির দিক থেকে দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার কারণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসীদের পাঞ্জাব-সিন্ধু-বেলুচিস্তান-সীমান্তপ্রদেশের জাতিসত্তা, গোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য, জীবনপ্রণালী, ধ্যানধারণা, আচারাচরণ, ভাষা, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য স্বাধীন থাকা সত্ত্বেও চৌদ্দ-আনাই এক, অন্যদিকে পূর্ব-বাংলার সঙ্গে পনেরো-আনাই ভিন্ন, এক-আনা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের সূত্রে বাঁধা। পশ্চিমাঞ্চলের সাহিত্য বাঙালি-হৃদয়ে কখনই ছাপ ফেলতে পারেনি, কারণ বাঙালির
নিজস্ব সাহিত্য-ধারা হাজার হাজার বছরের পুরনো, যা একান্তভাবেই বাঙালির। গবেষণার সন্ধানে পাওয়া যাবে যে, বাংলা সাহিত্যের
পথযাত্রা সেই পাণ্ড্ররাজার ঢিবির সময় থেকেই শুরু
৫. নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বৈষম্য : প্রাদেশিক পর্যায়েও অবস্থা ভিন্নতর ছিল না। ১৯৪৭-৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানের ৪ জন গভর্নরের মধ্যে মাত্র ১ জন ছিলেন বাঙালি। গভর্নরগণ ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের মনোনীত ব্যক্তি এবং প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা ও প্রশাসনের উপর তাঁদের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ছিল।
৬. উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ক্ষেত্রে বৈষম্য কেন্দ্রীয় সরকার আমলাতন্ত্রের মাধ্যমেও পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করত। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে আগত মোট ৯৫ জন আই. সি. এস. ও আই. পি. এস অফিসারের মধ্যে মাত্র ১ জন ছিলেন বাঙালি। সুতরাং পাকিস্তানের প্রথম দশকে কেন্দ্রীয় ও পূর্ব বাংলার সচিবালয়ে সকল মুখ্য পদে পশ্চিম পাকিস্তানিরা অধিষ্ঠিত ছিল। এক হিসাব মতে ১৯৫৬ সালে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে মোট ১৯৩ জন সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ১৩ জন এবং তাদের মধ্যে কেউই সচিবের পদে ছিলেন না। পাকিস্তান আমলে চাকরি ও নিয়োগের ক্ষেত্রেও বৈষম্যতার চিত্র পাওয়া যায়

১. কেন্দ্রীয় বেসামরিক চাকরির ক্ষেত্রে ৮৪% পাকিস্তানি ও ১৬% বাঙালি।
২. বৈদেশিক চাকরির ক্ষেত্রে ৮৫% পাকিস্তানি ও ১৫% বাঙালি। ৩. সশস্ত্র বাহিনীতে ৫ লক্ষ পাকিস্তানি ও ২০ হাজার বাঙালি।

৪. স্থলবাহিনীতে ৯৫% পাকিস্তানি ও ৫% বাঙালি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক উন্নয়ন (১৯৭১-বর্তমান)
৫. বিমান বাহিনীতে ৯১% পাকিস্তানি ও ৯% বাঙালি। ৬, নৌবাহিনীর কারিগরি চাকরির ক্ষেত্রে ৯১% পাকিস্তানি ও ৫%
বাঙালি প্রভৃতি।

দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য | ঢ। সামরিক বাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য : সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল আরও কম। ১৯৬৫ সালে মোট ১৭ জন জেনারেল, লেঃ জেনারেল ও মেজর জেনারেলের মধ্যে মাত্র ১ জন মেজর-জেনারেল ছিলেন বাঙালি। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর অফিসার শ্রেণিতে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব ছিলেন যথাক্রমে ৫%, ১০% ও ১৬%।
ণ। ক্ষমতার হিস্যা না পাওয়া : একটি অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ছিল জাতীয় ক্ষমতার হিস্যা লাভকল্পে বাঙালিদের দ্বারা পরিচালিত সংগ্রামেরই অংশ। কিন্তু ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল’ প্রবর্তনের ফলে ১৯৫৯ সালের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বানচাল হওয়া, ১৯৬২ সালে প্রদেশগুলোতে কোনো ক্ষমতা না দিয়ে প্রধান নির্বাহী ও কেন্দ্রের হাতে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে সংবিধান প্রণয়ন এবং প্রত্যক্ষ ভোটের অধিকার হরণ বাঙালিদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় যে, তারা জাতীয় ক্ষমতার হিস্যা কখনো পাবে না। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠার দাবির মধ্যে বাঙালি মুসলিমদের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি নিহিত ছিল। ১৯৪৬-৪৭ সালে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার যে দাবি তুলেছিলেন এইচ. এস. সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম, তাও বাঙালি মুসলিমদের সেই দাবিরই পুনরুক্তি। লাহোর প্রস্তাবের পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহ এবং সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা’ এ উভয় উদ্যোগের পেছনে এ ধারণাই কাজ করেছিল যে, বাঙালিরা কখনো কেন্দ্রীয় ক্ষমতার হিস্যা
পাবে না, কাজেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হতে পারে একমাত্র স্বায়ত্তশাসন লাভের মাধ্যমে। ৯. ভাষাগত বৈষম্য : পাকিস্তান একটি বহুভাষার রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধান ভাষা হিসেবে উর্দু ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া জাতিগঠনের জন্য একটি সমস্যা হিসেবে উদ্ভূত হয়। যেমন- বাংলা ভাষাভাষী ৫৬%, পাঞ্জাবি ২৯.০২, পশতু ৩.৭৮, সিন্ধি ৫.৫০, উর্দু ৩.৬৫ এবং বেলুচী ১.০৯%। আর যখন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে চাইল তখন পূর্ব পাকিস্তানের ৫৬% এ দাবিকে মানতে রাজি হয় নি বলে ভাষা আন্দোলন নামক আন্দোলনের সূচনা ঘটে। কেননা বাঙালি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, ‘বাঙালি যে বাঙালি হয়েছে তার কারণ বাংলাভাষা। প্রফেসর ড. নজরুল ইসলাম (Prof. Dr. Nazrul Islam) বলেছেন, “The linguistic differences intermixed by the geographical seperation complicated the problem of nation building in Pakistan.”

ত। ধর্মীয় বৈষম্য : পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে যদিও জাতীয় সংহতির সমস্যাটি প্রকট ছিল। তবে শুরুতে যতো না বেশি ছিল পরবর্তীতে তা প্রবল আকার ধারণ করে। কারণ, শুরুতে পাকিস্তানের জনগণ ধর্মীয় আবেগে ছিল আপ্লুত, কিন্তু পরবর্তীতে যখন পশ্চিম পাকিস্তানি মৌলবাদীরা ধারণা করতে লাগল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাঝে মুসলমান ও হিন্দু বলে কোনো পার্থক্য নেই, তখন থেকেই শুরু হয় ধর্মীয় ভেদাভেদ বা সংঘাত। প্রফেসর ড. নজরুল ইসলাম (Prof. Dr. Nazrul Islam) বলেছেন, “Common religious bonds between and within Pakistan weakened and were succeeded by the regional sentiments which gradually proved to be too great a strain for the fraught national structure.

থ। এলিট ও সাধারণ জনগণের বৈষম্য : পাকিস্তানের শাসন প্রক্রিয়ায় শাসক এলিটদের জনগণের যোগাযোগ ছিল বিচ্ছিন্ন।
জনগণের সার্বিক সমস্যা সম্পর্কে পাকিস্তানি এলিট গোষ্ঠীর ধারণা ছিল না। ফলে, জাতি গঠনের সমস্যার উদ্ভব ঘটে। এ প্রসঙ্গে
লিওনার্ড বাইন্ডার (Leonard Binder) বলেছেন, “The Issue of National Integration Subsumes the question of the political relationship between a modernizing elite and a traditional mass.” ১২. ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সামাজিক বৈষম্য : ঐতিহাসিক ও সামাজিক বৈষম্য পাকিস্তানের জাতীয় সংহতির ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। সামাজিক দিক থেকে বাঙালিরা ছিল সামন্তবাদের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের সামন্ত ও আধাসামন্ত ব্যবস্থাটি বিদ্যমান ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানিরা সাধারণত ইরান ও আফগানিস্তান উদ্বুদ্ধ ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত। অন্যদিকে, বাঙালিদের যোগাযোগ ছিল ভারত, বার্মা ইত্যাদি দেশ ও জাতির সাথে।

ন। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বৈষম্য : ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাব মিলে একক যুক্তাংশ সৃষ্টি করার পর, ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে, আইয়ুব খানের একক সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের রাজধানী করাচি থেকে ইসলামাবাদে স্থানান্তর করা হয়; আর পাঞ্জাবেরই আরেকটি শহর রাওয়ালপিন্ডিকে করা হয় সশস্ত্রবাহিনীর হেডকোয়ার্টার। এসব সিদ্ধান্তের কারণে কেবল আন্তঃপ্রদেশের মধ্যে বিরোধই বৃদ্ধি পায়নি, বরং পূর্ব-বাংলা ও পাঞ্জাবের মধ্যে শত্রুভাব বৃদ্ধি পায়।

প। খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ : খাদ্য সঙ্কট পূর্ব পাকিস্তানের নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি যখন তখন শোনা যাচ্ছিল। বলা বাহুল্য ১৯৪৮-৫১ বছরগুলোতে সারা পূর্ব বাংলা ছিল দুর্ভিক্ষ কবলিত। ১৯৪৯-৫০-এর দুর্ভিক্ষ কোনো কোনো অঞ্চলে মন্বন্তরের আকার ধারণ করেছিল। চাষিদের প্রায়ই অনাহার-অনটনে থাকতে হতো। অপুষ্টি ও ক্ষুধা ছিল তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। চালের দামসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য ছিল আকাশচুম্বী। খাদ্য ঘাটতি পূরণে সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। চলছিল বিলাসিতার স্রোত। এ পরিস্থিতিতেই আত্মপ্রকাশ করেছিল একটি স্লোগান ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়-লাখো ইনসান ভুখা হায়।

ফ। শিক্ষকদের দৈহিক নিপীড়ন: শিক্ষকদেরকে দৈহিকভাবে পীড়িত করবার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। একদা ইংরেজ অধ্যাপক ওটেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন দেশপ্রেমিকদের স্পর্শকরতায় আঘাত করেছিলেন বলে। ইতিহাসের কৌতুক এখানে যে, ওই ঘটনার পঞ্চাশ বছর পর ‘স্বাধীন’ পূর্ব পাকিস্তানে অধ্যাপক আবু মাহমুদকে সরকারি গুপ্তারা আক্রমণ করেছিল, তিনি দেশপ্রেমিক ছিলেন এ কারণে। পাকিস্তানিদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লাঞ্ছনা ওইখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ১৯৬৬ তে আবু মাহমুদের লাঞ্ছনার পাঁচ বছর পরে ১৯৭১-এ পাকিস্তানি হানাদাররা বহুসংখ্যক শিক্ষককে হত্যা করেছে, তাঁদের দেশপ্রেমের অপরাধে।
ব. বর্ণবাদী আচরণ : ১৯৮৬ তে সাহিত্যিক মোবাশ্বের আলী লিখেছেন ‘বাংলাদেশের সন্ধানে’ নামে একটি গবেষণাত্মক গ্রন্থ; তাতে তিনি কোনো বিশেষ সময়ে নয়, সব সময়েই বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগের কথা সন্তোষের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। বলছেন, এটা লক্ষণীয় যে, প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশ বৃহৎ পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন নয়; গুপ্ত আমলে সেকালের শ্রেষ্ঠ সভ্যতা আর্য সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত। মুসলমান শাসন আমলে সেসময়ের শ্রেষ্ঠ ইসলামী সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত এবং ইংরেজ আমলে সেসময়ের শ্রেষ্ঠ সভ্যতা ইংরেজ বা ইউরোপীয় সভ্যতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছে। অথচ সবকিছুর অন্তরালে নির্মম সত্য তো এটাই যে, বাংলাদেশের জন্য বহিরাগতের আধিপত্যের ব্যাপারটা না ছিল সম্মানজনক বা সর্বার্থে উপকারী। আর যে কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার মুসলমানদেরকে সব সময় নিম্ন শ্রেণির বলে মনে করতো এবং তারা নিজেরা উচ্চ বর্ণের বলে দাবি করতো।

দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য | ভ. শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য : শিক্ষাক্ষেত্রেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এক ব্যাপক অসম অবস্থা বিরাজমান ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পরবর্তী কয়েক বছরে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ অগ্রসর ছিল কিন্তু ক্রমে পশ্চিম পাকিস্তান পরবর্তী বিশ বছরে পূর্ব পাকিস্তানকে অনেক গুণে ছাড়িয়ে যায়। পাকিস্তানের দু অংশের জনগণের মাথাপিছু আয়ের পার্থক্য ছিল ১৯৬০ সালে শতকরা ৬৬ ভাগ। দশ বছর পর এ পার্থক্য ১৮৪ ভাগে গিয়ে উন্নীত হয়। অন্য কথায়, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের জীবনযাত্রার মান যেখানে বৃদ্ধি পেয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানে জীবনযাত্রার মান কেবল হ্রাস পাচ্ছিল। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের এ ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য অবশেষে দ্বৈত অর্থনীতির ধারণাটিকে (Concept of Two-Economy) সম্মুখে টেনে আনে।
ম. বাঙালিদের নিম্নশ্রেণি বলে গণ্য করা : পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কেবল বিপুল অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকারই হন নি, তাঁরা । পেয়েছেন অসম ব্যবহার ও নিদারুণ অবহেলা। বাঙালি সমৃদ্ধ ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকদের চোখে তাঁরা নিম্নশ্রেণি হিসেবে গণ্য হয়েছেন। এ বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি ক্রমশ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবহেলিত, বঞ্চনাক্লিষ্ট জনগণের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। জনগণ সম্পদের সমান অধিকার, সুষম উন্নয়ন ও সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের প্রতি পাকিস্তানিদের কোনো আস্থা ছিল না। মেধা থাকা সত্ত্বেও বাঙালিকে সামরিক বাহিনীতে উচ্চ পদ দেওয়া হয় নি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি।

য. বাঙালি সৈনিক ও অফিসারদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ : সেনাবাহিনীর পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা বাঙালি। অফিসারদের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করে। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার যে স্ফুরণ ঘটে, ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ছয় দফা আদায়ের সংগ্রাম এবং উনসত্তরের মহান গণআন্দোলন সর্বস্তরের জনগণ ও বাঙালি সামরিক অফিসার ও সৈন্যদেরকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। বিশেষত সত্তরের নির্বাচনি রায় বানচাল করার গণহত্যা থেকে রক্ষা করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া বাঙালি সামরিক অফিসার ও সৈন্যদের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না।

দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য | উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের শোষণপোষণ বন্ধ হওয়ার ফলে জনগণের আর্থিক অবস্থা বলিষ্ঠ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাস্তবে এর ফল হয় উল্টো। যে-পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ মরুভূমি আর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিল্পক্ষেত্রে পশ্চাদপদ ছিল সে পাকিস্তান ক্রমাগত ফুলেফেঁপে, ঐশ্বর্য্যে আর বৈভবে ভরে ওঠে; এর পাশাপাশি অগ্রসর পূর্ব-বাংলা ক্রমাগত অর্থনৈতিক শীর্ণতা ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার কারণে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জন্ম নেয় বাঙালির অন্তরে, ফলে পূর্ব বাংলায় অসন্তোষ এবং নৈরাশ্য সৃষ্টি হয়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম এ রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী ও সমরনায়করা দুটো অঞ্চলকে একত্রে ধরে রাখার যে আপোষের নীতি অবলম্বন করে তা ব্যর্থ নীতি; কারণ দুটো অঞ্চলের মধ্যে কোনোরকম স্বার্থের মিলন নেই, পারস্পরিক নির্ভরতা তো নেই, বরং ভূপ্রকৃতি-সভ্যতা-সংস্কৃতি-কৃষ্টি-ভাষা-খাদ্যাভ্যাসে অমিল, ধর্মও একত্রে ধরে রাখতে অক্ষম। অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভৌগোলিক কোনো ক্ষেত্রেই আধুনিক রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে না। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ও সমরনায়করা ২৪ বছর ধরে একটি স্থিতিশীল ও স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রাখতে অক্ষম হওয়ায় ১৯৭১-এর সঙ্কট সৃষ্টি হয়। এছাড়া পাকিস্তানের দুটো অংশের মধ্যে সবকিছুতেই বৈষম্য থাকায় ১৯৭১-এর সঙ্কট সমাধান করা অসম্ভব। একমাত্র সমাধানই হচ্ছে পাকিস্তানকে দুই ভাগে বিভক্ত করা। দীর্ঘদিনের সংঘাত জমতে জমতে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তা আগ্নেয়গিরীর মতো বিস্ফোরিত হয়। অবশ্য এর জন্য পাকিস্তানের শাসনগোষ্ঠী ও সমরনায়করাই দায়ী।

আরো পড়ুুন:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You're currently offline !!

error: Content is protected !!