পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ জীবনে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রভাব

পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ জীবনে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রভাব | ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার নিয়ন্ত্রণক্ষমতা চলে যায় ইংরেজদের হাতে। ইংরেজরা এদেশের শাসনভার গ্রহণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইংরেজরা এদেশ ছেড়ে চলে যায়। দীর্ঘ ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটে ১৯৪৭ সালে। এ সময় বাংলা ইংরেজ শাসনমুক্ত হয়।

বাংলা ইংরেজ শাসনমুক্ত হলেও পাকিস্তানিরা এর শাসনভার গ্রহণ করে। কিন্তু শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী সুকৌশলে বাঙালিকে পরনির্ভরশীল করে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের অপকৌশল গ্রহণ করে। যার ফলে উভয় পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্টি হয় নানা ক্ষেত্রে বৈষম্য। পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর এই বৈষম্যমূলক আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে থাকে।

এখনো amarStudy অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপটি ডাউনলোড না করে থাকলে গুগল প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপটি ইন্সটল করতে এখানে যানঃ Download Now. অ্যাপটি বিসিএস’সহ প্রায় সব রকমের চাকুরির প্রস্তুতির সহায়ক।

সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাঙালিদের স্বশাসনের দাবি মূর্ত হয়ে উঠে এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের মধ্যে দিয়ে বাঙালিদের স্বাতন্ত্র্য জাতীয়তাবোধ প্রকাশ পায় এবং পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে থাকে। একপেষেভাবে পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ আচরণে বাঙালিরা পাকদের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে থাকে। সেই সাথে পাকবাহিনীও বাঙালিদের দমনের জন্য নানা ধরনের দমন পীড়নের আশ্রয় নেয়।

যার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ছিল পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সামরিক শাসন। সামরিক শাসন জারি করে বাঙালিদের স্বশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার যে ব্যর্থ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল কালক্রমে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় জ্বলে উঠে এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

পূর্ববাংলার সমাজজীবনে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রভাব : মোগল শাসনামলে ইংরেজরা এদেশে প্রবেশ করে। ইংরেজরা ছাড়াও ইউরোপীয় বিভিন্ন জাতি এদেশে আগমন ঘটালেও তারা বেশিদিন টিকতে পারে নি। ইংরেজরা বাংলার নবাবকে পরাজিত করে এদেশের শাসনভার গ্রহণ করে। ইংরেজ শাসনের শুরু থেকে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এক পর্যায়ে ইংরেজরা এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা এদেশ ছেড়ে চলে গেলেও এর শাসনভার পাকিস্তানিদের হাতে চলে যায়। বাংলা ও বাঙালি জাতি দীর্ঘকাল ধরে বিদেশি কর্তৃক শোষিত হতে থাকে। বাঙালিরা যুগ যুগ ধরে শোষিত হয়েছে। শাসন করার কথা তারা কখনও ভাবতে পারে নি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বাংলার জনগণ পুনরায় কুচক্রী মহলের হিংস্র থাবায় পরিণত হয়। পূর্ব বাংলার সমাজজীবনে পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন প্রভাব পড়ে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ জীবনে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রভাব :

০১। রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বা আদর্শগত দ্বন্দ্ব : ১৯৪৭ সালে বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাকিস্তান ছিল হিন্দু ও মুসলিম দু’টি পৃথক সম্প্রদায়ের আবাসভূমি। পাকিস্তানের এ ধর্মীয় বিভেদ রাষ্ট্রীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছিল। পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল দ্বি জাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু পাকিস্তান বিভক্তির পর এর নেতৃত্ব চলে যায় পাশ্চাত্য চিন্তাচেতনা মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের হাতে। রাষ্ট্রের শাসনকর্তৃত্ব এ শ্রেণির হাতে চলে যাওয়ায় রাষ্ট্রীয় মূলনীতি বা আদর্শ নির্ধারণ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও আলেম সম্প্রদায়ের অবদান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম থেকেই মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

০২। রাষ্ট্র ও সরকারের প্রকৃতি : পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্রের গঠন ও প্রকৃতি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র
এককেন্দ্রিক হবে না কি যুক্তরাষ্ট্রীয় হবে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠে। ফলে জনমতের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

০৩। সংবিধানে প্রকৃতি : পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কেন্দ্র ও প্রদেশের সাংবিধানিক কাঠামো কি হবে তা নিয়ে মতভেদের সৃষ্টি হয়। কেন্দ্রে এককক্ষবিশিষ্ট সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত হবে না দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হবে তা নিয়ে বিতর্কের শুরু হয়।

০৪। কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টনের দ্বন্দ্ব : পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিন্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং পূর্ব বাংলা- এ পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। পাকিস্তানের বৃহৎ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকে মেনে নিয়ে যদি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রবর্তন করা হয় তাহলে সমস্যা থেকে যায়। কেন্দ্রে কী ধরনের সরকার কাঠামো থাকবে আর প্রদেশে কি ধরনের সরকার কাঠামো থাকবে এ নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এছাড়া সকল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যেহেতু এক ধরনের নয়, সেহেতু কেন্দ্র ও প্রদেশে সরকারের ক্ষমতার বিষয় নিয়েও সাংবিধানিক জটিলতা দেখা দেয়।

০৫। কেন্দ্রীয় আইনসভায় প্রতিনিধি বণ্টন নিয়ে বিতর্ক : পাকিস্তানে একাধিক প্রদেশের সমন্বয়ে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত হওয়ায় অনেকক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় আইনসভায় বিভিন্ন প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব বণ্টন নিয়ে বড় রকমের বিতর্ক দেখা দেয়।

০৬। নির্বাচন ব্যবস্থা : পাকিস্তান সৃষ্টির পর নির্বাচন ব্যবস্থার রূপ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। নির্বাচন ব্যবস্থার রূপ পৃথক না যুক্ত হবে এ বিষয়ে দীর্ঘ বিতর্কের সৃষ্টি হয়। একপক্ষ মনে করে পাকিস্তানে মুসলমানরা যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেহেতু পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার কোনো আবশ্যকতা নেই। তাই তারা যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থার পক্ষে মত দেয়। অন্যদিকে, দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে আদর্শিক কারণে হলেও নির্বাচন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার উপর গুরুত্বারোপ করে।

০৭। সংখ্যালঘুদের অধিকার : পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কিত বিষয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রে শতকরা প্রায় ১৫% সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ছিল। তাদের অধিকার ও ভূমিকা সম্পর্কে বিভিন্ন বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

০৮। রাষ্ট্রভাষা : পাকিস্তানি শাসনামলের প্রথম থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়। জাতির জনক বলে খ্যাত মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব বাংলাকে তাঁর (জিন্নাহ) ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত করার জন্য প্রথম ভাষার উপর আঘাত হানেন। তিনি ঘোষণা দেন, “উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” বাংলার জনমনে এ ধরনের ঘোষণার পর থেকে চরম অশান্তির সৃষ্টি হয়। পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি পরিচালিত হয়। বাংলার জনগণ জিন্নাহর ঘোষণাকে অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারমূলক বলে গ্রহণ করে। এ সময় হতেই বাঙালি জাতির বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করার দাবির সাথে বাঙালি জাতির জাতীয় চেতনা বৃদ্ধি পায় এবং এদের আঞ্চলিক আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।

০৯। আমলাতন্ত্র ও গণতন্ত্র : পাকিস্তানে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র ছিল শক্তিশালী ও সংগঠিত। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলসহ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কাঠামো ছিল খুবই দুর্বল। এ ধরনের অবস্থায় আমলাতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন দলগুলোর মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। সমাজজীবনে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

১০। আইনসভা ও শাসনবিভাগ : পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর প্রথমে সংসদীয় শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইনসভার কাছে শাসন বিভাগের জবাবদিহিতার ক্ষেত্র পরিষ্কার ছিল না। প্রধানমন্ত্রী শাসনকার্যে আইনসভাকে এড়িয়ে গভর্নর জেনারেলের সাথে বেশি যোগাযোগ রক্ষা করতেন। গভর্নর জেনারেল সবসময় আইন ও শাসনবিভাগকে পাশ কাটিয়ে চলতে পছন্দ করতেন।

১১। সাংস্কৃতিক অমিল : পাকিস্তানের সাথে বাংলার সাংস্কৃতিক পার্থক্য ছিল। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি
করে। দু’অঞ্চলের জনগণের জীবনযাত্রা ও আচার আচরণের পার্থক্য ছিল। এর ফলে দু’অঞ্চলের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ১২. নৈতিকতার অমিল : পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের জনগণের মধ্যে নৈতিকতার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিমা জনসাধারণের নৈতিকতা, উদারতা ও পূর্বাংশের জনসাধারণের সাথে কোনো অংশে মিল ছিল না। পশ্চিমারা ছিল রক্ষণশীল, সংকীর্ণমনা ও ধর্মান্ধ। অন্যদিকে, বাঙালিরা ছিল পাকিস্তানিদের তুলনায় উদার ও প্রগতিশীল।

১৩। উদ্বাস্তু সমস্যা : পাকিস্তান সৃষ্টির পর হাজার হাজার মুহাজির মুসলমান পাকিস্তানে আগমন ঘটায় এসব মুসলমানদের পাকিস্তানে হিজরতের ফলে উদ্বাস্তু সমস্যা দেখা দেয়।

১৪। রাজনৈতিক বৈষম্য : পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দু’অঞ্চলের মধ্যে চরমভাবে রাজনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান
রাষ্ট্রের একটি লক্ষ্য ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা ভুলে যায়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার জনগণ বৈষম্যের শিকার হয়।

১৫। প্রশাসনিক বৈষম্য : পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রশাসনিক ক্ষেত্রের বৈষম্য সবচেয়ে প্রকটরূপে দৃশ্যমান হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলার অফিসার ছিল খুবই সামান্য। স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীতে বাঙালিরা ছিল যথাক্রমে ৫%, ১০% ও ১৬%।

১৬। অর্থনৈতিক বৈষম্য : পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল খুব বেশি। পাকিস্তানের মোট জাতীয় আয়ে পূর্ব বাংলার অবদান বেশি থাকলেও এখানে খুব কম ব্যয় করা হতো। বেশিরভাগ শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
এছাড়াও বিভিন্ন অর্থ সংলগ্নকারী প্রতিষ্ঠান পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে উঠে বৈদেশিক সাহায্যের বেশিরভাগ ব্যয় করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।

উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে পূর্ব ববাংলার সমাজজীবন বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও বৈষম্যের সম্মুখীন হয়। সমাজজীবন এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। বাংলার জনগণ পাকিস্তানিদের এরূপ বৈষম্যমূলক আচরণ মেনে নেয় নি। তারা ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়।

আরো পড়ুুন:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You're currently offline !!

error: Content is protected !!