১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির অর্থনৈতিক পটভূমি সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
০১। চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্য : ব্রিটিশরা ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। এজন্য তারা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধান দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বদা বিভেদ লাগিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। তাছাড়া ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক দিক থেকে ইংরেজরা হিন্দুদের প্রতি একটু বেশি সহানুভূতিপ্রবণ ছিল।
এজন্য তারা তৎকালীন সরকারি, বেসরকারি উচ্চ পর্যায়ে কর্মকর্তা নির্বাচনে মুসলিমদের তুলনায় হিন্দুদের সহানুভূতি প্রাধান্য দিত। বস্তুত, চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দুদের একচেটিয়া নিয়োগ মুসলমানদের মনে ক্ষোভের জন্ম দেয়, যা পরববর্তীতে পাকিস্তান নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
০২। কৃষিক্ষেত্রে বৈষম্য : বরাবরই এ উপমহাদেশে কৃষি ছিল জীবিকানির্বাহ ও উৎপাদনের অন্যতম প্রধান বাহন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভূমি ও কৃষি ছিল ক্ষমতা প্রদর্শন ও জীবিকানির্বাহের প্রধান মধ্যম। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যেত তৎকালীন অধিকাংশ জমিদার, ধনী কৃষক শ্রেণিই হলো হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাছাড়া মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে কৃষির উন্নয়নে ইংরেজদের আগ্রহ ছিল না বললেই চলে। বস্তুত ভূমি ও কৃষিক্ষেত্রে এরূপ বৈষম্যমূলক নীতিই পাকিস্তানের আবির্ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পাকিস্তান সৃষ্টির অর্থনৈতিক পটভূমি :
০৩। শিল্পকারখানা স্থাপনে বৈষম্য : ব্রিটিশরা তাদের ঔপনিবেশিক শাসনামলে বিভিন্ন শিল্পকারখানা কোথায় স্থাপিত হবে আর
কোথায় স্থাপিত হবে না সে ব্যাপারে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে। বস্তুত এ বৈষম্যমূলক নীতি আরও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে যদি
সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করা যায় তৎকালীন কলকাতা, মুম্বাই, মাদ্রাজ কিংবা অন্যান্য হিন্দু অধ্যুষিত শহরে শিল্পকারখানার মাত্রা কিরূপ ছিল। পক্ষান্তরে, মুসলিম অধ্যুষিত ঢাকা, লাহোর, করাচি প্রভৃতি শহরে কলকারখানার চিত্র কিরূপ ছিল। আর এ কারণেও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
০৪। রাজস্ব খাত হতে খরচ সম্পর্কিত বৈষম্য : কলকাতা, মুম্বাইসহ অন্য সকল হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় যুদ্ধের খরচ এবং কোম্পানির কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হতো বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের রাজস্ব খাত থেকে। মূলত এতে করে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের রাজস্ব খাত প্রতিবছর একেবারে শূন্যের কোঠায় পড়ে যেত। ফলে এসব অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পায়, যা তাদের পৃথক রাষ্ট্র গঠনে উৎসাহিত করে।
পাকিস্তান সৃষ্টির অর্থনৈতিক পটভূমি || ০৫। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নয়ন: ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে ও বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে। তারা মুসলিম প্রধান এলাকাগুলোতে রাস্তা-ঘাট উন্নয়নের জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি। যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতি এরূপ বিমাতাসুলভ আচরণের অনিবার্য কারণ হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির দাবি ত্বরান্বিত হয়।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ বেনিয়া শাসকগোষ্ঠী এ উপহাদেশে তাদের কলোনি স্থাপন করেছিল। আর এ কলোনি টিকেছিল প্রায় ২০০ বছর। এ ২০০ বছরে তারা কেমন সব সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও বৈষম্যমূলক আচরণের জন্ম দেয়, যা ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত নামক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র জন্মলাভ করে।
আরো পড়ুুন:
- পাকিস্তান সৃষ্টির সামাজিক পটভূমি
- পাকিস্তান সৃষ্টির প্রধান কারণসমূহ
- স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে যুক্তি
- স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস
- লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ
- লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব
- লাহোর প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্যসমূহ
- ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের সংশোধন
- লাহোর প্রস্তাবের মূল আলোচ্য বিষয়
- ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি
- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাঃ দ্বিতীয় পর্ব
- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাঃ প্রথম পর্ব
- ভূগোল, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
- মৌর্য বংশ – প্রাক সুলতানী আমল
- মুঘল আমল – সাধারন জ্ঞান
- সুলতানী আমল – মুসলিম রাজত্ব
- মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য এবং মুসলিম কবি ও শাসকদের অবদান
- পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর পরিবর্তে কেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে?