অপারেশন সার্চলাইট বা ২৫ মার্চের কালরাত্রি বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিরঙ্কুর ভোটে পরাজিত হলেও বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তন্তর করতে নানা ষঙযন্ত্র করে। তার মধ্যে “অপারেশন সার্চলাইট” অন্যতম।
অপারেশন সার্চলাইটের প্রাথমিক প্রস্তুতি:
১৯৭০ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানিরা আওয়ামীলীগের কাছে বিপুল ভোটে হেড়ে গেলেও বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে নানা টালবাহানা শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের নামে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীরা কালক্ষেপণ শুরু করে।
আর এই সুযোগে তারা যুদ্ধের তূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে। অবশেষে ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা ত্যাগ করেন। তিনি ঢাকা ত্যাগ করার পূর্বেই বাঙালিদেরকে নির্বিচারে হত্যা করার নির্দেশ দেন, বাংলার ইতিহাসে যা “অপারেশন সার্চলাইট গণহত্যা” নামে পরিচিত।
অপারেশন সার্চলাইট গণহত্যার মূল পরিকল্পনা:
১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ চিফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদ খানের নির্দেশে জেনারেল খাদিম রাজা পরদিন ঢাকা সেনানিবাসের জিওসি অফিসে অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। পাঁচ পৃষ্ঠার এই চূড়ান্ত পরিকল্পনা রাও ফরমান আলী নিজে লিখেন। অপারেশন সার্চলাইট গণহত্যার জন্য যেসকল পরিকল্পনা নেওয়া হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নিচে দেওয়া হল:
- সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে একযোগে অপারেশন শুরু হবে।
- ঢাকার অপারেশনকে শতভাগ সফল করতে হবে।
- সেনানিবাসের নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।
- সর্বাধিক সংখ্যক ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের গ্রেফতার করতে হবে।
অপারেশন সার্চলাইটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা কর্মসূচীকে নস্যাৎ করা। কারণ- ইয়াহিয়া-ভুট্টো ভালভাবেই জানতেন ছয়দফা কর্মসূচী বাস্তবায়ন হলে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের অসীম ক্ষমতা আর থাকবে নাহ। অন্যদিকে, পূর্ব-পাকিস্তানে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে যে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল তা রোধ করাও অপারেশন সার্চলাইট গণহত্যার আরেকটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানিরা ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরে বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ার ধূলিসাৎ করে দেয়াও অপারেশন সার্চলাইট গণহত্যার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল।
অপারেশন সার্চলাইটের ফলাফল:
অপারেশন সার্চলাইটের নামে বর্বর পাকিস্তানি সেনারা নিরীহ, নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালিদের উপর গণহত্যা চালায় তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য সমস্যাকিছু বর্ণনা নিচে দেওয়া হলো:
র্ফামগেট, পুলিশ লাইন ও পিলখানায় আক্রমণ:
পূর্বপরিকল্পিত নকশা অনুযায়ী ২৬ মার্চ রাত ১ টায় অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহত্যা শুরুর পরিকল্পনা থাকলেও ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে টিক্কা খানের পাকিস্তানি ঘাতক সৈন্যরা ২৫ মার্চ রাত সাড়ে এগারোটায় অর্থাৎ, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গণহত্যার অভিযান শুরু করে। তারা ট্যাঙ্ক, মেশিনগান, মর্টার, ও অন্যান্যা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরীহ বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের প্রথম আক্রমণের শিকার হন ঢাকার র্ফামগেট এলাকায় মিছিলরত বাঙালিরা। একইসাথে তারা আক্রমণ চালায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ:
বাঙালি জাতিকে মেধাশুন্য করার প্রক্রিয়া হিসেবে ২৫ মার্চের কালরাত্রে বর্বর পাক সেনাদের অন্যতম টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। সেদিন রাতে তারা জুহুরুল হক হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল এবং স্টাফ কোয়ার্টারে ঢুকে গণহত্যা চালায়।
পত্রিকা অফিসে আগুন, সাংবাদিক বন্দি ও অন্যান্য এলাকায় আক্রমণ:
২৫ মার্চের গণহত্যার নিষ্ঠুর আক্রমণ যাতে গণমাধ্যমে প্রকাশ না পায় সেজন্য সাংবাদিকদের বন্দি করে বিভিন্ন প্রত্রিকার অফিসে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। একই সাথে ঢাকার বিভিন্ন যায়গায় এবং ঢাকার বাইরেও রজশাহী, চট্রগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, যশোর, পাবনা, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন পুলিশ ব্যারাক আক্রমণ করে পুলিশ হত্যা করে সেসব স্থান পাকিস্তানি সেনারা নিজেদের দখলে নেয়। উল্লেখ্য যে, মূলত ২৫ মার্চ গণহত্যার পর থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় এবং দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।