লাহোর প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্যসমূহ | আমরা জানি, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এক নতুন প্রেরণার সৃষ্টি করে। স্বতন্ত্র আবাসভূমির আশায় তারা আশান্বিত হয়ে ওঠে। ফলে, মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের রাজনীতি পৃথক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে পরিণত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমানদের পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবীকে অস্বীকার করে। যা পরবর্তীকালে বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করে।
তবে লাহোর প্রস্তাব মুসলিম লীগকে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দিক নির্দেশনা এনে দেয়। এর ফলে অতি দ্রুত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল এর প্রমাণ। লাহোর প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করলে এর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এরূপ অবস্থায় মুসলমান নেতৃবৃন্দ নিজেদের ভাগ্য সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ এ সময় তাঁর ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ (Two Nations Theory) উত্থাপন করেন। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনে জিন্নাহর এই ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের’ আলোকে ভারতবর্ষে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। লাহোর প্রস্তাব বিভিন্ন দিক থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে লাহোর প্রস্তাবের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হলো :
লাহোর প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্যসমূহ :
০১। এতে সীমানার পুনর্বিন্যাস করে ভৌগোলিক দিক থেকে পরস্পর নিকটবর্তী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোর
সমন্বয় সাধন করা হয়।
০২। ভৌগোলিক দিক থেকে নিকটবর্তী এলাকাসমূহকে পৃথক অঞ্চল বলে স্বীকার করা হয়।
০৩। উল্লিখিত উপায়ে গঠিত স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের অঙ্গরাজ্যসমূহ সম্পূর্ণভাবে স্বায়ত্তশাসিত হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
০৪। উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্ব ভারতের যেসব এলাকায় মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের সমন্বয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হবে।
০৫। নবগঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর সাথে পরামর্শক্রমে তাদের সাংস্কৃতিক, শাসনতান্ত্রিক এবং অন্যান্য
অধিকার ও স্বার্থ-সংরক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে।
০৬। ভারতের যে অংশ মুসলমানগণ সংখ্যালঘু তাদের এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শাসন ও অন্যান্য অধিকার সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট পন্থাসমূহ শাসনতন্ত্রে উল্লেখ করা হয়।
০৭। দেশে ভবিষ্যৎ যে কোনো শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনায় উপরিউক্ত বিষয়গুলোকে মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়।
লাহোর প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্যসমূহ | পরিশেষে বলা যায়, ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’ অবিভক্ত ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করে। লাহোর প্রস্তাব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত কংগ্রেস এবং ব্রিটিশ সরকারের সাথে আপস-মীমাংসা করে চলা, কাকুতি-মিনতি করে স্বার্থ সংরক্ষণ করাই ছিল মুসলিম লীগের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য।
লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হবার পর মুসলিম লীগের রাজনীতিতে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ উপস্থিত হয়। মুসলমানদের মধ্যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়। লাহোর প্রস্তাব মুসলমানদের সামনে এক নবদিগন্ত উন্মোচন করে দেয়। তারা অনুভব করে যে, তাদের আর সাংবিধানিক নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তার দরকার নেই। তখন থেকে মুসলিম রাজনীতির সুর ও লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় শুধু হিন্দুদের অবিচারের বিরুদ্ধে নালিশ নয় বরং পৃথক রাজনৈতিক অস্তিত্বের দাবি।
আরো পড়ুুন:
- ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের সংশোধন
- লাহোর প্রস্তাবের মূল আলোচ্য বিষয়
- ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি
- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাঃ দ্বিতীয় পর্ব
- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাঃ প্রথম পর্ব
- ভূগোল, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
- বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
- মৌর্য বংশ – প্রাক সুলতানী আমল
- মুঘল আমল – সাধারন জ্ঞান
- সুলতানী আমল – মুসলিম রাজত্ব
- মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য এবং মুসলিম কবি ও শাসকদের অবদান
- পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর পরিবর্তে কেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে?