সংবিধানের মৌলিক কাঠামো

সংবিধানের মৌলিক কাঠামো : প্রতিটি লিখিত সংবিধানে কতিপয় মৌলিক উদ্দেশ্য থাকে যা ব্যহত হলে সংবিধান উহার স্বকীয়তা বা আত্নপরিচয় হারিয়ে ফেলবে সেইসব উদ্দেশ্যকে মৌলিক কাঠামো বলা যেতে পারে।

সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধারণার প্রেক্ষাপটঃ

ভারতঃ ১৯৬৭ সালে ভারতে গোলকনাথ মামলায় সর্বপ্রথম সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। বিচারপতি কে সুব্বারাও অভিমত দিয়েছিলেন সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংশোধন করা সম্ভব নয়।এছড়া আরো অভিমত দেওয়া হয় যে , পার্লামেন্টের সংবিধান সংশোধনের সাহায্যেও মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করা অধিকার নেই ।
১৯৭৩ সালে কেশবানন্দ ভারতী মামলায়ও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত বিষয়টি বিশদভাবেভাবে আলোচনা করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ট রায়ে এই অভিমত প্রকাশ করা হয় যে, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা যায়না।
১৯৮০ সালের মিনার্ভা মিলস মামলায় সুপ্রীম কোর্ট আবার অভিমত দেয় যে, সংবিধান সংশোধনের সাহায্যে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা যায়না।
এভাবে ভারতে তিনটি মামলায় সংবিধানের মৌলিক কাঠামো কথাটি প্রাধান্য পায়।
কিন্ত মৌলিক কাঠামো বলতে কোন কোন বিষয়কে বুঝায় সে বিষয়ে কোন মামলায় বিচারকগণ মতৈক্যে পৌছাতে পারেন নি।

এখনো amarStudy অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপটি ডাউনলোড না করে থাকলে গুগল প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপটি ইন্সটল করতে এখানে যানঃ Download Now. অ্যাপটি বিসিএস’সহ প্রায় সব রকমের চাকুরির প্রস্তুতির সহায়ক।

বাংলাদেশঃ বাংলাদেশে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ব্যাপারটি উঠে আসে অষ্টম সংশোধনী মামলা চলাকানীন সময়ে। অষ্টম সংশোধনীতে সংবিধানের ১০০ নং অনুচ্ছেদ সংশোধন করে হাইকোর্টের ৬টি বেঞ্ছ স্থাপন করা হয় ৬ টি জেলায়। এতে দুটি পৃথক রীট পিটিশনের মাধমে এই সংশোধনী অসাংবিধানিক ও ক্ষমতা বহির্ভুত বলে চ্যালেঞ্জ করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগ ১৯৮৮ সালের ১৫ই আগস্ট রীট খারিজ করে দেয়। আপিল বিভাগ আপিলের অনুমতি দেয়।

আপিল বিভাগ এ মামলায় রায় দিয়েছিল যে ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১০০ নং অনুচ্ছদের যে সংশোধন করা হয়েছে তা অসিংবাধিক ,ক্ষমতা বহির্ভুত এবং অকার্যকর।
অথচ সংবিধানের ১৪২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদের দুই তৃতীয়াংশ ভোটে সংবিধানের যেকোন বিধান সংশোধন করা যাবে। তাইলে কিসের ভিত্তিতে আদালত ৮ম সংশোধনী বাতিল করে দিল। এই মামলার রায়ের সারসংক্ষেপ আলোচনা করলে বুঝা যায়। তিন বিচারপতির রায়ের যুক্তিগুলো নিম্ন রুপঃ

১। সংবিধানের কতিপয় মৌলিক বৈশিষ্ট রয়েছে যা পার্লামেন্ট তার সংশোধনী ক্ষমতাবলে সংশোধন করতে পারেনা । কারন এই মৌলিক কাঠামোগুলোকে সংশোধন করার ক্ষমতা দিলে সংবিধান তার মৌলিকত্ব হারিয়ে ফেলবে। এরুপ মৌল কাঠামোর মধ্যে কতগুলো হলঃ

ক। জনগনই সার্বভৌমত্বের মালিক
খ। সংবিধানের প্রাধান্য
গ।গনতন্ত্র
ঘ। প্রজাতান্ত্রিক সরকার
ঙ। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র
চ।বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

এই মৌল কাঠামোর সংসদের সংশোধনী ক্ষমতার বাহিরে অবস্থান করে। সুতরাং যদি এগুলো সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন করা হয় তাহলে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা আছে উক্ত সংশোধনী বাতিল করার। ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১০০ নং অনুচ্ছদের যে সংশোধন করা হয়েছে তা সুপ্রীম কোর্টের একাধিক আসন তৈরী করেছে এবং ইহা বিচার বিভাগের যে একেককেন্দ্রিক বৈশিষ্ট রয়েছে তাকে ধ্বংস করেছে এবং এক স্থায়ী বেঞ্চ থেকে অন্য বেঞ্চের বিচারকদের বদলীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কে ক্ষুন্ন করার পথ করে দিয়েছে। সুতরাং উক্ত সংশোধনী “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ” নামক মৌলিক কাঠামো কে ধ্বংস করেছে।

২। এ সংশোধনী সংবিধানের ৪৪,৯৪,১০১ এবং ১০২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। সংশোধনীটি ১০৮,১০৯,১১০,১১১ এবং ১১২ অনুচ্ছেদ কে অর্থহীন করেছে এবং ইহা প্রত্যক্ষভাবে ১১৪ অনুচ্ছেদ কে লংঘন করেছে ।তাছাড়া একটি স্থায়ী বেঞ্চ থেকে অন্য বেঞ্চে মামলা হস্তান্তরের কোন বিধান সংশোধনীতে করা হয়নি। সুতরাং সংশোধনীটি অবৈধ ও অসাংবিধানিক।

৩। ৮ম সংশোধনী প্রস্তাবনার একটি উদ্দেশ্য আইনের শাসনের কাঠামো কে ধ্বংস করেছে সুতরাং ইহা প্রস্তাবনার বিরোধী হওয়ায় অসাংবিধানিক।
উপরোক্ত রায়ের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ৮ম সংশোধনীকে বাতিল করার পিছনে ৩ জন বিচারপতিই একটি যুক্তির উপর সর্বাধিক ঝুকেছেন ।আর সেটি হল সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। যদিও একেক জন একেকভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
তবে ১৫ তম সংশোধনীতে এটি পরিষ্কার হয়েছে।

মৌলিক কাঠামোর বর্তমান অবস্থাঃ

২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে ৭খ অনুচ্ছেদ সংযোজন করা এবং সংবিধানের কোন বিধানগুলো Basic structure বা মৌল কাঠামো হিসেবে গণ্য হবে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। এতে মৌলিক কাঠামোর একটা নতুন ধারনা তৈরী করে ।
অনুচ্ছেদ ৭খ অনুসারে নিন্মলিখিত বিধানগুলো হলো মৌল কাঠামো যা সংশোধনের অযোগ্য:-
– প্রস্তাবনা
– প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ অর্থাৎ অনুচ্ছেদ ১-৭খ।
– দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ অর্থাৎ অনুচ্ছেদ ৮-২৫।
– নবম-ক ভাগ সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ অর্থাৎ অনুচ্ছেদ ২৬-৪৭ক।
– একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদ অর্থাৎ ৫ম, ৬ষ্ঠ এবং ৭ম তফসিল।
এছাড়া ২৬ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছেঃ

(১) এই ভাগের (মৌলিক অধিকার ) বিধানাবলীর সহিত অসমঞ্জস সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, এই সংবিধান-প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।

(২) রাষ্ট্র এই ভাগের কোন বিধানের সহিত অসমঞ্জস কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।

(৩) সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত সংশোধনের ক্ষেত্রে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই প্রযোজ্য হইবে না।

অতএব “মৌল কাঠামো” বাংলাদেশের সংবিধানে সাংবিধানিক প্রাধান্য প্রতিষ্টিত করেছে । এতে আইনের শাসন,বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আর মৌলিক অধিকার পরিপন্থি কোন পদক্ষপ নেওয়ার পথ রুদ্ধ হল ।

সুত্রঃ ০১। ৮ম সংশোধনী মামলা (আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ)
সুত্রঃ ০২। সাংবিধানিক আইনের বিভিন্ন রেফারেন্স বই

মুহাম্মদ ইরফান উদ্দীন
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা(সুপারিশপ্রাপ্ত)
৩৭ তম বিসিএস নন-ক্যাডার

আরো পড়ুন:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You're currently offline !!

error: Content is protected !!