১৯৭০ সালের নির্বাচন, গুরুত্ব ও ফলাফল

১৯৭০ সালের নির্বাচন | যুক্তফ্রন্টের ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর ১৯৭০ সালের নির্বাচনই ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ। এজন্য এই নির্বাচনের গুরুত্ব সর্বাধিক। এছাড়া বাঙালি জাতিয়তাবাদ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পিছনে বিভিন্ন দিক থেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নিচে এই নির্বাচনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:


বাঙালি স্বাতন্ত্র্যবাদের বিজয়:

১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তির পর থেকেই বাঙালি জাতি ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্যবাদ দাবি করে আসছিল। তবে তৎকালীন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কুচক্রী শাসকবর্গ নানাভাবে তাদেরকে দাবিয়ে রেখেছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির সেই স্বাতন্ত্র্যবাদের বিজয় ঘটে।

এখনো amarStudy অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপটি ডাউনলোড না করে থাকলে গুগল প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপটি ইন্সটল করতে এখানে যানঃ Download Now. অ্যাপটি বিসিএস’সহ প্রায় সব রকমের চাকুরির প্রস্তুতির সহায়ক।

আঞ্চলিক প্রাধান্য: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ও পিপিপি আঞ্চলিক প্রাধান্য লাভ করে। ফলে উভয় দলই এককভাবে কোনো অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব করার বৈধতা হারায়। একই সাথে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব-পাকিস্তান শাসন অবৈধ বলে প্রমাণিত হয়।


স্বায়ত্তশাসনের দাবির বৈধতা প্রমাণ:

বাঙালি জাতি দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে আন্দোলন করে আসছিল। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এ দাবি অবৈধ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল। অবশেষে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণের রায় বাঙালির ছয়দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির বৈধতা প্রমাণ করে।


বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ়করণ: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ব-বাংলায় যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে তা আরো বেশি সুদৃঢ় হয়।


পাকিস্তানিদের শোষণ থেকে মুক্তির চেতনা অর্জন:

পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পূর্ব বাংলার জনগণের উপর শোষণ-নিপিড়নমূলক আচরণ শুরু করে। এমন প্রেক্ষাপটকে ঘিরেই ১৯৭০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার মুক্তিকামী জনতার চেনতা আরো বেশি বৃদ্ধি পায়, যা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তৃত্ব হ্রাস: দীর্ঘ ২৪ বছর পশ্চিম পাকিস্তান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে ইচ্ছেমতো শাসন ও শোষণ করেছে। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুর ভোটে তাদের পরাজয় ঘটলে দীর্ঘদিনের রাজত্বে অশনি সংকেত দেখা দেয় এবং কর্তৃত্ব হ্রাস পায়, যা তাদের কাছে ছিল চরম অবমাননাকর ও ঈর্ষণীয়।


সংগ্রামী মনোভাব সৃষ্টি:

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের জয় লাভের পরও ইয়াহিয়া-ভুট্টো সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা শুরু করে। ইয়াহিয়া জতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করে এবং স্থগিত ঘোষণা করেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সংগ্রামমুখর হয়ে উঠে। যার প্রেক্ষিতে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন, যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়।


অধিকার আদায়: সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সকল দিক থেকেই পূর্ব-বাংলার জনগণ লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যে অভূতপূর্ব বিজয় অর্জিত হয়, তার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পূর্ব-বাংলার আপামর জনতা নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত হয় এবং ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের জন্ম হয়।


উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের পথ প্রশস্ত করে। এ নির্বাচনের ফলাফলের পথ ধরেই বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম এবং দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। সুতরাং, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম।


১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল:

জাতীয় পরিষদ: সমগ্র পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ছিল ৩১৩ টি। এর মধ্যে সাধারণ আসন ছিল ৩০০ টি এবং সংরক্ষিত মহিলা আসন সংখ্যা ছিল ১৩ টি। ৩১৩ আসনের মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ছিল ১৬৯ টি। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ছিল ১৪৪ টি। নির্বাচনি ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামীলীগ পূর্ব-পাকিস্তানের ১৬৯ টি সাধারণ আসনের মধ্যে সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ মোট ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি ১৩৮ টি সাধারণ আসনের মধ্যে সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ সর্বমোট ৮৮ টি আসন পায়।


প্রাদেশিক পরিষদ: সমস্ত পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের মোট আসন সংখ্যা ছিল ৬২১ টি। নির্বাচনী ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামীলীগ ৩০০ টি সাধারণ আসনের মধ্যে ২৮৮ এবং সংরক্ষিত ১০ টি আসনের সবকয়টিসহ মোট ২৯৮ টি আসনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অন্যদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে পিপিপি’র চরম পরাজয় ঘটে। নিম্নে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলের একটি চার্ট দেওয়া হলো:


দলপ্রার্থীসাধারণ আসনমহিলা আসনমোট
আওয়ামীলীগ৩০০২৮৮১০২৯৮
পিডিপি১৪৪
জামায়াতে ইসলামী১৭৪
ন্যাপ১০৭
স্বতন্ত্র৪৮
মোট৩০০১০৩১০

উপরোক্ত চার্ট থেকে বলা যায় যে, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গের শোষণমূলক কৃতকর্মের জন্য ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ফলে নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুর সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং পিপিপি প্রচুর ভরাডুবিতে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে, এ নির্বাচনের ফলাফলই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পথ প্রশস্ত করে।


তথ্য সংগ্রহ করে লিখেছেন: Al-Amin Islam | অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো ভুল হয়ে থাকলে মেসেজ করে জানানোর অনুরোধ রইল।

আরো পড়ুন:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You're currently offline !!

error: Content is protected !!