লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব

লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব | ১৯৩৭ সালের প্রথম দিকে ভারতে প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ভারতীয় কংগ্রেস দল ছয়টি প্রদেশে পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। মুসলিম লীগ কংগ্রেসের সাথে যুক্তভাবে মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব করলে কংগ্রেস তা অস্বীকার করে। মুসলিম লীগ বাংলা ও পাঞ্জাবে সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করে। কিন্তু কংগ্রেস ১৯৩৭ সালের জুন মাসে ৬টি প্রদেশে এককভাবে মন্ত্রিসভা গঠন করে।

অন্যদল থেকে মন্ত্রী গ্রহণ না করায় বিশেষ করে যুক্ত প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। কংগ্রেস শাসিত প্রাদেশিক সরকারগুলো সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতে শুরু করে। আইন-আদালত এবং শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে কংগ্রেসী পতাকা উত্তোলন ও বন্দেমাতরম সঙ্গীত গাইবার ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে ভারতের বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হয়।

এখনো amarStudy অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপটি ডাউনলোড না করে থাকলে গুগল প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপটি ইন্সটল করতে এখানে যানঃ Download Now. অ্যাপটি বিসিএস’সহ প্রায় সব রকমের চাকুরির প্রস্তুতির সহায়ক।

এই ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় হিন্দু-মুসলিম স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এরূপ অবস্থায় মুসলমান নেতৃবৃন্দ নিজেদের ভাগ্য সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ এ সময় তাঁর ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ (Two Nations Theory) উত্থাপন করেন। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনে জিন্নাহর এই ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের’ আলোকে ভারতবর্ষে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। লাহোর প্রস্তাব বিভিন্ন দিক থেকে
অতি গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে এর গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :

লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব :

০১। মুসলিম লীগের গুরুত্ব বৃদ্ধি : লাহোর প্রস্তাবের মূল বিষয়সমূহ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, এর ফলে উপমহাদেশে কংগ্রেসের পাশাপাশি মুসলীম লীগও একটি শক্তিশালী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের পাশাপাশি মুসলিম লীগের দাবি দাওয়ারও গুরুত্ব দিতে থাকে।

০২। রাজনীতির নতুন ধারা ও স্বাধীনতা আইন পাস : লাহোর প্রস্তাবের ফলে ভারতের রাজনীতি নতুন ধারায় প্রবাহিত হতে
থাকে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ভারতের সামাজিক অবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সরকার অনুভব করে যে, ভারতে একটিমাত্র রাষ্ট্র গঠন সংকটের কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারবে না। ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা আইন পাস হয়।

০৩। নবদিগন্তের সূচনা : লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হবার পর মুসলিম লীগের রাজনীতিতে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ পায়।
মুসলমানদের মধ্যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়। ফলে, মুসলমানদের মধ্যে এক নবদিগন্তের পথ উন্মোচিত হয়।

০৪। মুসলিম জাতীয়তাবাদের উন্মেষ: ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে হিমালয়ান উপমহাদেশে মুসলিম জাতীয়তাবাদ তীব্র হয়ে উঠে এবং বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে মনযিলে মকসুদের দিকে এগিয়ে যায়। বর্ণহিন্দু ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণ ও শাসন থেকে মুক্তির বার্তা নিয়ে এ জাতীয়তাবাদ মুসলমানদের মধ্যে ঐতিহাসিক একাত্মবোধ জাগ্রত করে।

০৫। স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের উদ্ভব : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ফলে ব্রিটিশ ভারতে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের কথা উল্লেখ হয়। অন্যকথায় জাতিগত দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এর ফলে উপমহাদেশে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
করা

০৬। ‘স্বাধীন শব্দের প্রথম ব্যবহার : ভারতবর্ষের রাজনৈতিক শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব অপরিসীম। এ প্রস্তাবের পূর্বে ভারতের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রধান দাবি ছিল স্বায়ত্তশাসন। এ প্রস্তাবের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ভারতবর্ষে মুসলিম লীগ কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে ‘স্বাধীন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

০৭। ধর্মীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা : লাহোর প্রস্তাব উপমহাদেশের মুসলিম জাতি একটি আদর্শিক জাতি হিসেবে আদর্শিক ঐক্যের ভিত্তিতে
প্রতিষ্ঠিত হয়। শক্তিশালী হয় মুসলিম জনগোষ্ঠী। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে এবং বাঙালি মুসলমানরাসহ
উপমহাদেশের মুসলমানরা নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে একাত্মতা অনুভব করে তার গতিকে ত্বরান্বিত করে।

০৮। নির্বাচনে ব্যাপক জনসমর্থন : ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ যেখানে মোট ৪৮৫টি মুসলিম আসনের মধ্যে ১০৯টি আসন লাভ করে, সেখানে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের পর ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে এ দল মোট ৪৯২টি আসনের মধ্যে লাভ করে ৪২৮টি আসন।

০৯। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বীজ লাহোর প্রস্তাবকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে এটি স্পষ্ট হয় যে, এ প্রস্তাবের মধ্যেই বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের ভিত্তিতে। পূর্ববাংলায় স্বায়ত্তশাসনের সকল আন্দোলনে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের দিক নির্দেশনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ১৯৫৪ সালের ২১ দফা কর্মসূচি ও ১৯৬৬ সালের ৬ দফা কর্মসূচিতে লাহোর প্রস্তাবের সরাসরি উল্লেখ রয়েছে। তাই বলা যায়, লাহোর প্রস্তাবে বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিক সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল (Sardar Ballav Bhai Patel) বলেন যে, ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান দু’টি পৃথক ও স্বতন্ত্র জাতি। বিশিষ্ট কংগ্রেস মুসলিম নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর India Wins Freedom 2 , “I was surprised and pained when Patel in reply said that whether we liked it or not, there were two nations in India.” সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ব্রিটিশ ভারতের সাংবিধানিক অগ্রগতি এবং মুসলমানদের জন্য একটা পৃথক আবাসভূমির দাবি উত্থাপনের ক্ষেত্রে এক অনন্য সাধারণ সাংবিধানিক ঘটনা এদিক থেকে লাহোর প্রস্তাবকে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ (Pakistan Resolution) বললেও অত্যুক্তি হয় না।

আরো পড়ুুন:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You're currently offline !!

error: Content is protected !!