আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাখাইন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

রাখাইনকে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করলে লাভ বা ক্ষতি কি?

রাখাইন বার্মার একটি প্রদেশ, বার্মার পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। এর উত্তরে চীন, পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগ। আরাকান পর্বত, যার সর্বোচ্চ চূড়া ভিক্টোরিয়া শৃঙ্গের উচ্চতা ৩,০৬৩ মিটার যা রাখাইন প্রদেশকে মূল বার্মা থেকে পৃথক করে রেখেছে। রাখাইন রাজ্যের আয়তন ৩৬,৭৬২ বর্গকিলোমিটার এবং এর রাজধানীর নাম সিত্তে।

আয়তনগত গুরুত্ব: বাংলাদেশের আয়তন ৫৫ হাজার বর্গমাইল যেখানে রাখাইন বা আরাকান রাজ্যের আয়তন ১৪,১৯৪ বর্গমাইল বা ৩৭ হাজার বর্গকিলোমিটার । যেটা বাংলাদেশের চার ভাগের একভাগের থেকেও বেশি।

এখনো amarStudy অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপটি ডাউনলোড না করে থাকলে গুগল প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপটি ইন্সটল করতে এখানে যানঃ Download Now. অ্যাপটি বিসিএস’সহ প্রায় সব রকমের চাকুরির প্রস্তুতির সহায়ক।

সমুদ্রসীমাগত গুরুত্ব: রাখাইনের জনসংখ্যা ৪১ লক্ষ এবং বার্মার সব থেকে দরিদ্র অঞ্চলগুলির একটি। যদিও রাখাইনের সাথে সমুদ্রসীমা যতটুকু তা প্রায় বাংলাদেশের মোট সমুদ্রসীমার কাছাকাছি। আর এই বিষয়টি রাখাইনকে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। এর রাজধানী সিত্তও। রাখাইনেই চীন সমুদ্র বন্দর করছে যেটার ৭০% মালিকানা চীনের।


রাখাইন কেন গুরুত্বপূর্ণ?

এখন কথা হল আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা সঙ্কটের সময় বলেছিলেন, বিশ্বের শক্তিশালী কোন এক দেশ বাংলাদেশকে বলেছে যে যদি বাংলাদেশ চায় তবে সামরিক সহযোগিতা দিতে তারা প্রস্তুত।
উল্লেখ্য, এটা দিয়ে যে বার্মার সাথে কোন যুদ্ধে ‘আমেরিকা’ সহায়তা দিতে চেয়েছে সেটা বুঝতে বাকি থাকে না। কারণ আমেরিকার কংগ্রেসম্যান ইতিমধ্যে বলেছেন, রাখাইনকে স্বাধীন বা বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করে দিতে। এটা বাস্তবিক অর্থে কখনো সম্ভব না। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিও এটা সমর্থন করে না।


বাঘে-মহিষে লড়াইয়ের মাঝে রাখাইন:

কিন্তু রাখাইনে চীনের যেমন স্বার্থ রয়েছে ঠিক তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থও রয়েছে। কারণ যেখানে চীন সেখানে যুক্তরাষ্ট্রও থাকার চেষ্টা করবে। এত দীর্ঘ সমুদ্রসীমা রাখাইনকে কার্যত বঙ্গোপসাগরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অন্যতম মাধ্যমে পরিণত করেছে। বাংলাদেশের সাথে যদি রাখাইন যুক্ত হতো তবে বঙ্গোপসাগরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের হাতেই থাকত। তাতে বার্মাকে পড়ত হতো সঙ্কটে। কারণ বঙ্গোপসাগরের সাথে যুক্ত তাদের প্রধান রাজ্য হল রাখাইন। এই রাজ্য হারালে কার্যত বঙ্গোপসাগরে তাদের নিয়ন্ত্রণ শূন্যের কোঠায় দাঁড়াতো।


রাখাইনকে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত করা কতটুকু সম্ভব?

রোহিঙ্গা সমস্যা গুরুতর সমস্যা। কিন্তু মনে হয় না মিষ্টি কথায় এর কোন সমাধান খুব শীঘ্রই হচ্ছে। তাই বার্মার সাথে মিষ্টি কথা বাদ দিয়ে একটু শক্তি প্রদর্শন জরুরি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিতে পারতো। চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ নয়। বরং চীনা বিনিয়োগ বার্মার থেকে বাংলাদেশে বহুগুণ বেশি। তথাপি চীনকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে খুব বেশি টলানো যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সংযুক্তি চীনকে এই ইস্যুতে নতুন ভাবে অবস্থান নিতে বাধ্য করতো।

কূটনৈতিক ও সামরিক টোপ ব্যবহার: যেহেতু সামরিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বার্মাকে ভীত করার মত অবস্থানে নেই এবং বার্মাও বাংলাদেশকে ভীত করার মত অবস্থানে নেই, সেক্ষেত্রে চীনকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলার জন্য আহবান জানানো যেতো। চীন সাড়া না দিলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক মহড়া করা যেতো বঙ্গোপসাগরে। বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ আসলেই যে তারা বাংলাদেশ দখল করে নিবে এমন কিছু নয়। এখানে তেল নেই। তাই এখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ তেলের জন্য না। বরং বঙ্গোপসাগরে চীনের প্রভার কমিয়ে মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধি করা হলো যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য।


বাংলাদেশের কী কৌশলগত ভুল ছিল?

এখানে বলে রাখা ভাল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বড় সামরিক মহড়া এবং বার্মা সীমান্তে প্রকাশ্যে ভারি অস্ত্রের সমাবেশ এবং দুই চারটা কড়া হুমকি দিলে বার্মাকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করা যেত। হুমকি যা দেবার জাতিসংঘ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে। এখন হুমকির বাস্তবতা ধরে রাখতে সামরিক উপস্থিতি জরুরি। যেটা বাংলাদেশের একার পক্ষে সম্ভব না। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা এটা সম্ভব ছিল। এরকম কিছু করলে চীন বাংলাদেশকে একপাক্ষিক ভাবে দোষ চাপাতে পারতো না। কারণ আমরা চীনকে আগেই বলে রেখেছি এই ইস্যু সমাধান করার জন্য। অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের কথা চিন্তা করেও চীন তার অবস্থান পরিবর্তন করা দরকার ছিল।

Divide and Distribution theory এর প্রয়োগ:

ধরে নেই, রাখাইনের মত প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর রাজ্য বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হয়েছে। আমার ব্যাক্তিগত মত হল রাখাইনের দুই তিনটা দ্বীপ যদি আমরা চীনকে অথবা যুক্তরাষ্ট্রকে অফার করি তাতেও আমি কোন লোকসান দেখি না।

Coercive Diplomacy এর প্রয়োগ:

সামরিক উপস্থিতির রাজনৈতিক ভূমিকা অনেক গভীর। ১৯৭১ সালে রাশিয়াকে যুদ্ধে জড়াতে হয়নি। তাদের যুদ্ধজাহাজ বঙ্গোপসাগর অভিমুখে রওনা করার সাথে সাথে আমেরিকা তার ৭ম নৌবহর ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের মত দেশের ভাঙ্গন হয়। সেখানে বার্মা তো অনেক দুর্বল।

রাখাইন কী পূর্ব তিমুর হবে নাকি দক্ষিণ সুদান?

নতুন ভূখণ্ড নিয়ে নতুন দেশ গঠন এটা অলিক কল্পনা বলেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। পূর্ব তিমুর যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইন্দোনেশিয়া থেকে পৃথক হয়ে আলাদা দেশ হয়েছে। বার্মা নিশ্চয় ইন্দোনেশিয়ার মত শক্তিশালী দেশ নয়? দক্ষিণ সুদান পৃথক হয়েছে সুদান থেকে। রাশিয়া তো কয়েক বছর আগে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নিজেদের ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করেছে মার্কিন ও ইউরোপীয়দের চোখ রাঙিয়ে। ইউক্রেনও কোন দুর্বল রাষ্ট্র নয়। সুপার পাওয়ারদের কাছে কে এগিয়ে; বাংলাদেশ নাকি বার্মা? তাই যদি বাংলাদেশের সত্যিকার ইচ্ছে থাকে এবং যুক্তরাষ্ট্রের যদি সত্যিকারের স্বার্থ থাকে; তবে বার্মা তাদের দেশকে অখণ্ড রাখতে পারবে না। এমনিতেই দেশটি বিদ্রোহীদের সাথে সংঘর্ষে জর্জরিত। এখানে ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করবে রাশিয়া এবং চীন উভয় দেশ ভেটো দিবে। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের বিপক্ষে যুদ্ধ কখনো করবে না তারা। বার্মা যতই আপন হোক। বাংলাদেশের সাথে রাশিয়ার এবং চীনের সম্পর্ক মোটেও খারাপ নয়। সুতরাং এতে পরিস্থিতি যা দাঁড়াবে তাহলো- চীন-রাশিয়া একটু নড়েচড়ে বসবে। যুক্তরাষ্ট্র যাতে এখানে না জড়ায় তারা সবকিছুই করবে। তারাই বার্মাকে দিয়ে বলাবে যে, রোহিঙ্গাদেরকে তারা ফিরিয়ে নেবে এবং নাগরিকত্ব দেবে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের অফারকে বাংলাদেশের উচিত কাজে লাগানো।


রাখাইন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য:

রাখাইনকে বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান ব্রাড শেরম্যানের প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। রাখাইন মিয়ানমারের অংশ। আমরা এটা (রাখাইন) চাই না। কখনই চাইব না। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার মানে এই না যে, তাদের একটা অংশ নিয়ে চলে আসব। সেই মানসিকতা আমাদের নেই। সেখানে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে রাখাইনকে জুড়ে দিতে চায় কেন? এ প্রস্তাব কখনও গ্রহণযোগ্য নয়।’

প্রধানমন্ত্রী কেন এই কথা বলেছেন?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেকগুলো কারণে এই কথা বলেছেন। কারনগুলা হলোঃ
– ভৌগোলিকভাবে ভারত তিনটি সীমানা দিয়ে বাংলাদেশকে ঘিরে রেখেছে। দুই প্রতিবেশীর বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক তেমন ভালো নয়। এখন মিয়ানমারের সাথেও সম্পর্ক খারাপ করলে আমরা ভৌগোলিকভাবে একা হয়ে পড়বো। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তা একেবারেই অসম্ভব।
– আমাদের সংবিধানের পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত ২৫ অনুচ্ছেদ এই নীতির পরিপন্থী।
– আমাদের উন্নয়ন অংশীদার চীন ও ভারতের কাছে আমরা অবিশ্বাসী হয়ে যাবো।
– জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী কাজ এটি।
– বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল ঝুকিপূর্ণ হয়ে পড়বে।


লিখেছেন : হাসান জাহিদ স্যার

আরো পড়ুন:


Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You're currently offline !!

error: Content is protected !!