এই আর্টিকেলটি লিখার সময় পর্যন্ত বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে এক আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস । ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বেও এই আতঙ্গের বাইরে নয়। আজকে আমরা করোনা ভাইরাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।
করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি :
করোনা ভাইরাস ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা যায়। পরে সাধারণ সর্দি-হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এরকম দুই ধরনের ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি ‘মনুষ্য করোনা ভাইরাস ২২৯ই’ এবং ‘মনুষ্য করোনা ভাইরাস ওসি৪৩’ নামে নামকরণ করা হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির আরো বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৩ সালে। ‘এসএআরএস-সিওভি’, ২০০৪ সালে ‘এইচসিওভি এনএল৬৩’, ২০০৫ সালে ‘এইচকেইউ১’, ২০১২ সালে ‘এমইআরএস-সিওভি’ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সাল চীনে ‘নোভেল করোনা ভাইরাস’। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসের ফলে শ্বাসকষ্টের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়। তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া
করোনা ভাইরাস এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস – যা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯ – এনসিওভি বা নভেল করোনাভাইরসা। এটি এক ধরণের করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ছয়টি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। তবে নতুন ধরণের ভাইরাসের কারণে সেই সংখ্যা এখন থেকে হবে সাতটি।
২০০২ সাল থেকে চীনে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স (পুরো নাম সিভিয়ার এ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৭৭৪জনের মৃত্যু হয়েছিল আর ৮০৯৮জন সংক্রমিত হয়েছিল। সেটিও ছিল এক ধরণের করোনা ভাইরাস। নতুন এই রোগটিকে প্রথমদিকে নানা নামে ডাকা হচ্ছিল, যেমন: ‘চায়না ভাইরাস’, ‘করোনা ভাইরাস’, ‘২০১৯ এনকভ’, ‘নতুন ভাইরাস’, ‘রহস্য ভাইরাস’ ইত্যাদি। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটির আনুষ্ঠানিক নাম দেয় কোভিড-১৯ যা ‘করোনা ভাইরাস ডিজিজ ২০১৯’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। তথ্য সুত্র: বিবিসি
করোনা ভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতি (২০১৯-২০২০):
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনা ভাইরাসের একটি প্রজাতির সংক্রামণ দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘২০১৯-এনসিওভি’ নামকরণ করে। ২০২০ সালের ১৩ মার্চ পর্যন্ত চীনের সাথে সাথে ১২১টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে সংক্রমণের খবর পাওয়া যায় যাতে ৫০০০ জনের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। নিশ্চিতভাবে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে আরো ১,৩৫,১৬৬ জন রোগী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং ৭০,৩৯৫ জনের বেশি লোক চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে ওঠেছে বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। উহানে দেখা দেওয়া ভাইরাস প্রজাতিটি ‘এসএআরএস-সিওভি’ প্রজাতির সাথে ~৭০% জিনগত মিল পাওয়া যায়।[৭] অনেকেই অনুমান করছেন নতুন এ প্রজাতিটি সাপ থেকে এসেছে যদিও অনেক গবেষক এ মতের বিরোধীতা করেন। তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রাথমিক লক্ষণ :
রেসপিরেটরি লক্ষ্মণ ছাড়াও জ্বর, কাশি, শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যাই মূলত প্রধান লক্ষ্মণ। এছাড়াও আরো কিছু লক্ষণ নিচে দেওয়া হলো:
- জ্বর
- অবসাদ
- শুষ্ক কাশি
- বমি হওয়া
- শ্বাস কষ্ট
- গলা ব্যাথা
- অঙ্গ বিকল হওয়া
- কিছু রোগীর ক্ষেত্রে উপরোক্ত সকল উপসর্গ দেখা গেলেও জ্বর থাকেনা।
কতটা ভয়ংকর এই করোনা ভাইরাস ?
শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য অসুস্থতার মতো এই ভাইরাসের ক্ষেত্রেও সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা এবং জ্বরসহ হালকা লক্ষণ দেখা দিতে পারে । কিছু মানুষের জন্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। এর ফলে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং অর্গান বিপর্যয়ের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। তবে খুব কম ক্ষেত্রেই এই রোগ মারাত্মক হয়। এই ভাইরাস সংক্রমণের ফলে বয়স্ক ও আগে থেকে অসুস্থ ব্যক্তিদের মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে যে বিষয়গুলি মনে রাখবেন:
গণপরিবহন: গণপরিবহন এড়িয়ে চলা কিংবা সতর্কতার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাস, ট্রেন কিংবা অন্য যে কোন ধরণের পরিবহনের হাতল কিংবা আসনে করোনা ভাইরাস থাকতে পারে। সেজন্য যে কোন পরিবহনে চলাফেরার ক্ষেত্রে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করা এবং সেখান থেকে নেমে ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করার উপর গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
কর্মক্ষেত্র: কর্মক্ষেত্র অফিসে একই ডেস্ক এবং কম্পিউটার ব্যবহার করলেও ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাঁচি-কাশি থেকে করোনা ভাইরাস ছড়ায়। যে কোন জায়গায় করোনা ভাইরাস কয়েক ঘন্টা এমনকি কয়েকদিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে। অফিসের ডেস্কে বসার আগে কম্পিউটার, কিবোর্ড এবং মাউস পরিষ্কার করে নিন।
জনসমাগমস্থল: জনসমাগমস্থল যেসব জায়গায় মানুষ বেশি জড়ো হয় সেসব স্থান এড়িয়ে চলা কিংবা বাড়তি সতর্কতার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে খেলাধুলার স্থান, সিনেমা হল থেকে শুরু করে ধর্মীয় স্থানও রয়েছে। বাংলাদেশের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে জুমার নামাজের সময় বাড়ি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। সৌদি আরব ইতোমধ্যেই ওমরাহ বন্ধ করেছে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান: ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যখন গ্রাহকরা যায় তখন অনেকেই একটি কলম ব্যবহার করেন। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কোন ব্যক্তি যদি সে কলম ব্যবহার করে তাহলে পরবর্তী ব্যবহারকারীদেরও করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। সেজন্য নিজের কলম আলাদা করে রাখতে পারেন। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে। এছাড়া টাকা উত্তোলনের জন্য যে এটিএম বুথ ব্যবহার করা হয়, সেখান থেকেও সংক্রমণ হতে পারে। কারণ এটিএম বুথের বাটন অনেকে ব্যবহার করে।
লিফট: লিফট ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে আরেকটি জায়গা হতে পারে বাড়ি কিংবা অফিসের লিফট। লিফট ব্যবহারের সময় নির্ধারিত ফ্লোরে যাবার জন্য লিফটের বাটন অনেকে ব্যবহার করছেন। বিভিন্ন অফিস ভবনে প্রতিদিন শত-শত মানুষ লিফট ব্যবহার করছেন। এদের মধ্যে কেউ যদি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী থাকেন এবং সে লিফটের বাটনে অন্যদের আঙ্গুল গেলেও সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে।
টাকা-পয়সা: টাকা-পয়সা ব্যাংক নোট বা টাকায় নানা ধরণের জীবাণুর উপস্থিতি শনাক্ত করার ঘটনা নতুন নয়। এমনকি ব্যাংক নোটের মাধ্যমে সংক্রামক নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ার কথাও বলেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের একদল গবেষক গত বছরের অগাস্ট মাসে বলেছিলেন, তারা বাংলাদেশি কাগুজে নোট ও ধাতব মুদ্রায় এমন ধরণের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পেয়েছেন, যা সাধারণত মল-মূত্রের মধ্যে থাকে। গতমাসে ভাইরাসের উপস্থিতি নিয়ে টাকা বা ব্যাংক নোট জীবাণুমুক্ত করার একটি উদ্যোগ দেখা যায় চীনে। দেশটিতে সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর সেখানে ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকাতে বাজার থেকে ব্যাংক নোট সরিয়ে নিয়ে তা আবার জীবাণুমুক্ত করে বাজারে ছাড়ে দেশটি।
শুভেচ্ছা বিনিময়: শুভেচ্ছা বিনিময় করমর্দন এবং কোলাকুলির মাধ্যমেও করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে। আপনি যে ব্যক্তির সাথে কোলাকুলি এবং করমর্দন করছেন, তিনি যদি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন তাহলে সেটি অন্যের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। এজন্য করমর্দন এবং কোলাকুলির না করার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সবকিছুর মূল কথা হচ্ছে নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখা। হাত না ধুয়ে নিজের মুখমণ্ডল স্পর্শ করবেন না। এটি হলে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য নিয়মিত ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করছেন বিশেষজ্ঞরা।