১৮৫৭ সালের সংগ্রাম- সিপাহী বিদ্রোহ

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ কে ভারতীয় উপমহাদের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা হয়। নানাবিধ কারণে এই সংগ্রাম শুরু হয়। এসব কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক কারণ। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ

রাজনৈতিক কারণঃ

পলাশীর যুদ্ধের পরে ইংরেজরা তাদের কূটকৌশলে রাজ্য বিস্তার নীতি প্রয়োগ করে দেশীয় রাজাদের শঙ্কিত করে তোলে। তারা দিল্লির সম্রাটকে নিজেদের সম্রাট মনে করতেন। তৎকালীন সময়ে ডালহৌসি ঘোষণা করেন যে, দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পরে দিল্লীর দরবার বিলুপ্ত হবে। এ ঘটনা জনসাধারণ বিশেষ করে মুসলমানদের মনে আঘাত হানে। তাই তারা ব্রিটিশদেরকে এদেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত হয়।

এখনো amarStudy অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপটি ডাউনলোড না করে থাকলে গুগল প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপটি ইন্সটল করতে এখানে যানঃ Download Now. অ্যাপটি বিসিএস’সহ প্রায় সব রকমের চাকুরির প্রস্তুতির সহায়ক।

অর্থনৈতিক কারণঃ

সিপাহী বিদ্রোহ তথা ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম সংগঠিত হওয়ার আরেকটি অন্যতম করণ হলো অর্থনৈতিক কারণ। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একচেটিয়া ব্যবসা শুরু করে ফলে আমাদের দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, কুটির শিল্প ইত্যাদি ধ্বংস হয়ে যায়। আমাদের দেশের প্রচুর পরিমাণ সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার করা হয়। চাকরির ক্ষেত্রেও দেশীয়দের বঞ্চিত করা হয়। যোগ্যতা থাকলেও দেশীয়দের উপযুক্ত চাকরি দিতো না। ফলে দেশবাসী দিন দিন ইংরেজদের উপর চড়াও হতে থাকে এবং ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের মাধ্যমে তাদের পুঞ্জিভুত ক্ষোভের বহিপ্রকাশ ঘটায়।


সামাজিক কারণঃ

তৎকালীন (১৮২৮ থেকে ১৮৩৫) ভারতীয় গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সমাজ সংস্কার করেন, যা গোঁড়া হিন্দুদের অসন্তুষ্ট করে তোলে। বিশেষ করে সতীদাহ প্রথা নিবারণ ও বিধবা বিবাহ প্রচলনকে তখনও হিন্দগণ মেনে নিতে পারেনি। ফার্সি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজিকে সরকারি অফিস আদালতের ভাষা করায় মুসলমানগণও অসন্তুষ্ট হয়। আর তাই মুসলমান-হিন্দু দু শ্রেণীই ব্রিটিশ শাসনের আবসান কামনা করত।


ধর্মীয় কারণঃ

পাদ্রীগণ এদেশের জনগণকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। শাসকশ্রেণীও তাদেরকে এ ব্যপারে সহায়তা করত। তারা এদেশের যুব সম্প্রদায়কে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত কারার জন্য নানা ধরণের লোভ-লালসা দেখাত। বক্তৃতা করে কিংবা পত্রিকায় লিখে হিন্দু-মুসলমানদের ধর্ম বিদ্বেষী কথা বলত, ফলে স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু-মুসলীমরা ব্রিটিশদের উপর ক্ষিপ্ত হতো।


সামরিক কারণঃ

কোম্পানির সৈন্যবাহিনীতে দেশীয় ও ইউরোপীয়দের মধ্যে বিরাট বৈষম্য ছিল। যোগ্যতা থাকলেও দেশীয়দের উচ্চপদ দেওয়া হতোনা। এভাবে দেশীয়দের সাথে সবধরণের বৈষম্য বিরাজমান ছিল। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৫৭ সালে এনফিল্ড নামে নতুন রাইফেল চালু হয়। এ রাইফেলের টোটায় চর্বি মাখানো ছিল। এই টোটা দাঁতে কেটে রাইফেলে ঢুকানো হতো। সেসময় গুজব রটল যে টোটায় যেসব চর্বি মাখানো হতো সেগুলো গরু এবং শুকুরের চর্বি ছিল। যা হিন্দু-মুসলীমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে চরম আঘাত হানা দেয়। ফলে তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে চড়াও হয়ে উঠে।


বিদ্রোহ ও সংগ্রামঃ

১৮৫৭ সালের ২৬ শে জানুয়ারি বঙ্গদেশের ব্যারাকপুরে সিপাহীরা প্রথম বিদ্রোহ শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় বহরমপুর ও মীরাটে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সিপাহীগণ দিল্লী অধিকার করে বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট বলে ঘোষণা করে। অযোধ্যা ও রোহিলাখন্ডের শাসকগণ সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। ক্রমান্বয়ে মীরাট, লক্ষৌ, কানপুর, বেরিলি, ঝাঁসি ইত্যাদি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে থাকে।


সংগ্রামের ব্যর্থতাঃ

শেষ পর্যন্ত ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ব্রিটিশরা চার মাস দিল্লী অবরোধ করে রাখার তা দখল করে নেয়। ধৃত সৈনিক ও সাধারণ মানুষের উপর তারা নির্মমভাবে অত্যাচার চালায়। বহু নিরপরাধ নরনারী, শিশু বৃদ্ধদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেওয়া হয়। বেশ কয়েকজন শাহাজাদাকে হত্যা করা হয়। ক্রমান্বয়ে ইংরেজগণ লক্ষৌ দখল করে নেয়। সংগ্রামের অন্যতম নেতা মৌলভি আহমেদ উল্লাহ যুদ্ধে নিহত হয়। ইংরেজরা কানপুর দখল করে নেয়। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই যুদ্ধে আহত হন। পরে তিনি মারা যান। ঝাঁসি ইংরেজদের দখলে আসে। প্রায় এক বছর স্বাধীন থাকার পর ইংরেজদের হাতে রোহিলাখন্ডের পতন হয়। ১৮৫৭ সালের ৭ জুলাই উপমহাদেশে ইংরেজগণ শান্তি ঘোষণা করার মাধ্যমে বিদ্রোহের অবসান হয়।


যুদ্ধে ব্যর্থতার কারণঃ

১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালিত হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে তা পরিচালিত হয়। সুষ্ঠু কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলনা। সিপাহীদের অন্ত্রশন্ত্রও তেমন ছিলনা। অন্যদিকে ইংরেজদের অন্ত্রশস্ত্র এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অনেক উন্নত। তাদের যুদ্ধ পরিচালনাও ছিল সুপরিকল্পিত। এছাড়াও নেপাল, পাঞ্জাব এবং হায়দ্রাবাদ ছাড়াও অনেক দেশীয় রাজ্যের শাসকগণ ইংরেজদের সৈন্য দিয়ে সহযোগিতা করে। মূলত এসব কারণে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।


সিপাহী বিদ্রোহের ফলাফলঃ

এই সংগ্রামের ব্যর্থতার পর ইংরেজগণ মুসলমানদের উপর চড়াও হয় এবং প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করে। বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেওয়া হয়। অনেক সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। দিল্লী দখলের পরে বেশি কিছুদিন ইংরেজরা এদেশীয় মানুষ দেখলেই তারা তাকে হত্যা করত। তবে এ সংগ্রাম পুরোপুরি বিফলে যায়নি। সংগ্রামের পরে ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে এতবড় একটা দেশের শাসনভার একটি কোম্পানির হাতে রাখা সম্ভব নয়। তাই তারা উপমহাদেশকে সরাসরি তাদের হাতে তুলে নেয়ার জন্য ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক আইন পাশ করে। ফলে উপমহাদেশের শাসনভার সরাসরি ব্রিটেনের রানির হাতে চলে যায় এবং ১৮৫৮ সালে ভারতে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে। তখন থেকে ভারতের শাসনকর্তাকে ভাইসরয় বলা শুরু হয়। এভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা সিপাহী বিদ্রোহের অবসান হয়।


আরো পড়ুন:

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You're currently offline !!

error: Content is protected !!