ইংরেজ শাসনামলে আমাাদের বর্তমান বাংলাদেশ, ভারতের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা ও ছিটনাগপুর নিয়ে বৃহৎ বঙ্গ প্রদেশ গঠিত হয়। এ প্রদেশের রাজধানী হয় কলকাতা। কলকাতা একই সাথে আবার ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীও ছিল। একজন লে: গভর্নর জেনারেল কলকাতা থেকে এই বিশাল বঙ্গ প্রদেশ শাসন করতো।
যার আয়তন ছিল ১ লক্ষ ৮৯ হাজার বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৮০ লক্ষেরও বেশি। কাজেই স্বাভাবিকভাবে একজন গভর্নর জেনারেলের দ্বারা এতবড় প্রদেশের শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব ছিলনা। মুলত প্রশাসনিক এই জটিলতার কারণেই ব্রিটিশরা বঙ্গভঙ্গ করে। নিম্নে বঙ্গভঙ্গের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণসমূহ আলোচনা করা হলোঃ
প্রশাসনিক কারণঃ
১৯০৩ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মোট আয়তন ছিল ১,৮৯,০০০ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৮ কোটির কাছাকাছি। একজন গভর্নর জেনারেল সঠিকভাবে এই প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারতো না। কাজেই প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর প্রথমবারের মতো তৎকালীন ভারতীয় ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করেন। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে পূর্ববাংলার(বর্তমানে বাংলাদেশ) ভাগে পড়ে ঢাকা, রাজশাহী ও চট্রগ্রাম বিভাগ এবং এর সাথে আসামকে যুক্ত করে এই প্রদেশের নাম রাখা হয় পূর্ববঙ্গ ও আসাম। অন্যদিকে, প্রেসিডেন্সি, বর্ধমান বিভাগ এবং বিহার, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুর নিয়ে গঠিত প্রদেশের নাম হয় বঙ্গদেশ।
রাজনৈতিক কারণঃ
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পিছনে লর্ড কার্জনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বিদ্যমান ছিল। তিনি লক্ষ করেছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীরাই ভারতে জাতীয়তাবাদ এবং ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনের অগ্রনায়ক। যেহেতু পূর্ববাংলায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং পশ্চিমবাংলায় হিন্দুরা সংখ্যা গরিষ্ঠ তাই বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হলে উভয়ের মধ্যে দুরত্ব তৈরি হবে এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণঃ
ভারতবর্ষে ইংরেজদের কাছে শাসনক্ষমতা হারিয়ে মুসলমানগণ সামাজিকভাবে নিজেদের হেয় প্রতিপন্ন মনে করে। হারানো গৌরব ফিরে পেতে মুসলমানরা বঙ্গভঙ্গের প্রতি সমর্থন জানায়। অন্যদিকে, কলকাতায় শিল্প-কলকারখানা গঙে উঠেছিল পূর্ব-বাংলার কাচাঁমালের উপর নির্ভর করে। অথচ পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তাই ব্রিটিশরা ভেবেছিল বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করলে পূর্ব-বাংলা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে উন্নত হবে।
বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়া ও রদঃ
বঙ্গভঙ্গ বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে গুণগত পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। তৎকালীন বাংলার নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে বাঙালী মুসলমানগণ বঙ্গভঙ্গকে স্বাগত জানিয়ে আসছিল। কারণ- তারা মনে করেছিল যে, বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববঙ্গে শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের সুবিধা ও উন্নতির পথ সুগম হবে। অন্যদিকে, পশ্চিম বাংলার শিক্ষিত হিন্দুদের অনেকেই মনে করে বঙ্গভঙ্গের ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বাঙ্গালী জাতি দ্বিখন্ডিত হবে। তাই তারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলে।
এ আন্দোলনের একটি বিশেষ দিক ছিল স্বদেশী পণ্যের ব্যাপক প্রচলন এবং বিদেশী পণ্য বর্জন করা। তাই এই আন্দোলনকে স্বদেশী আন্দোলনও বলা হয়। অবশেষে কংগ্রেস ও শিক্ষিত হিন্দুদের প্রবল চাপে ১৯১১ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ বঙ্গভঙ্গ রদ করেন। তবে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলেও বিহার, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুরকে বঙ্গদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে সরিয়ে নেওয়া হয়। জেনে রাখা ভালো ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “আমার সোনার বাংলা” গানটি লিখেন; যা পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিত হিসেবে স্বীকৃতি পায়।